অপরূপ প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড (Sitakunda) উপজেলা ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য। এখানে রয়েছে অনেক গুলো জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চন্দ্রনাথ পাহাড়, মহামায়া লেক, গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত, কুমিরা ঘাট, বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, ঝরঝরি ঝর্ণা ট্রেইল, কমলদহ ঝর্ণা ট্রেইল এবং সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক।
রাজধানী ঢাকা, কুমিল্লা, নরসিংদী, ফেনী, চট্টগ্রাম বা তার আশপাশ থেকে সহজেই একদিনে সীতাকুণ্ড ঘুরে ফিরে আসা যায়। যদিও একদিনে সীতাকুন্ডের সব জায়গা ঘুরে দেখা সম্ভব না। তবে ডে ট্যুর হিসেবে চন্দ্রনাথ পাহাড়, খৈয়াছড়া ঝর্ণা এবং গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত সিংহভাগ ভ্রমণকারীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। যদিও খৈয়াছড়া ঝর্না মিরসরাই উপজেলায় পরেছে কিন্তু সীতাকুন্ড থেকে কাছে হওয়ায় এবং একদিনে পাহাড়, ঝর্ণা ও সমুদ্র এই দিন ধরণের প্রকৃতির ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্যে খৈয়াছড়া ঝর্ণাও আমাদের এই ট্যুর প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডে ট্রিপের জন্যে আপনি চাইলে আপনার মত করে সীতাকুণ্ডের অন্যান্য জায়গা ভ্রমণের জন্যে নির্বাচন করতে পারেন।
কিভাবে যাবেন
ঘোরাঘুরির জন্য সম্পূর্ন একদিন হাতে পেতে রাতে বেলা ট্রেন বা বাসে সীতাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিন। ঢাকা থেকে চট্রগ্রামগামী বাসে সরাসরি সীতাকুণ্ড যাওয়া যায়। সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, মহাখালি বাস স্ট্যান্ড হতে এস আলম, শ্যামলি, সৌদিয়া, ইউনিক, হানিফ, ঈগল ও এনা সহ বিভিন্ন পরিবহনের এসি/নন-এসি বাস চলাচল করে। নন-এসি বাসে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৪২০ থেকে ৪৮০ টাকা এবং এসি বাসের টিকেট মূল্য ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সীতাকুণ্ড যেতে চাইলে আপনাকে ফেনী রেলওয়ে ষ্টেশনে নেমে সেখান থেকে ১০-১৫ টাকা রিক্সা/অটো দিয়ে ফেনী মহিপাল বাস স্ট্যান্ড যেতে হবে। মহিপাল বাস স্ট্যান্ড হতে ৫০-৮০ টাকা ভাড়ায় লোকাল বাসে চড়ে সীতাকুন্ড যেতে পারবেন। তবে রাত ১০ টা ৩০ মিনিটে কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন হতে মেইল ট্রেনে জনপ্রতি ১২০ টাকা ভাড়ায় সরাসরি সীতাকুণ্ড যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে সিট পেতে চাইলে আপনাকে অনেক আগে থেকেই ট্রেনে বসে থাকতে হবে।
অথবা অন্য কোন জেলা থেকে আসতে চাইলে এমন ভাবে সীতাকুন্ড চলে আসুন যেন সকাল সকাল সীতাকুন্ড চলে আসতে পারেন। এতে করে সারাদিন ঘুরে বেড়াবার সময় হাতে থাকবে।
কিভাবে ঘুরবেন
এই তিনটি জায়গা ডে ট্যুর এর জন্যে সবচেয়ে ভাল হবে প্রথমে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে চলে গেলে, তারপর সেখান থেকে খৈয়াছড়া ঝর্না দেখে বিকেলে গুলিয়াখালি ভ্রমণের জন্যে সময় রাখলে।
সীতাকুণ্ড বাজারে সকালের নাস্তা সেরে জনপ্রতি ২০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় চলে যান প্রথম গন্তব্য চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় আছে ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথ মন্দির। হিন্দু ধর্মালম্বী দর্শনার্থীদের পাশাপাশি সকল ধর্মের ভ্রমণকারী মন্দির দর্শনের সাথে সাথে এই পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। পাহাড়ে উঠার সময় অবশ্যই সাথে করে পানি, স্যালাইন, শুকনো খাবার এবং ছোট বাঁশ নিয়ে নিবেন। কারণ পাহাড়ের উপরে কোন কিছু কিনতে চাইলে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর চন্দ্রনাথ পাহাড় চূড়ায় উঠতে প্রায় ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মত সময় লাগবে।
চন্দ্রনাথ পাহাড় সীতাকুণ্ড
চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে তারপরের গন্তব্য ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের দূরত্বে রয়েছে আরেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার খৈয়াছড়া ঝর্ণা। চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে সীতাকুণ্ডে ফিরে লোকাল বাসে চড়ে ২০ টাকা ভাড়ায় চলে যান মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের কাছে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে। আইডিয়াল স্কুলের কাছে ১০০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় খৈয়াছড়া ঝর্ণার ঝিরির কাছে যাওয়া যায়। আপনি না চিনলে বাসে হেল্পারকে বলুন খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যাবেন। বাসের হেল্পার আপনাকে আপনাকে ঝর্ণায় যাবার রাস্তায় নামিয়ে দিবে। খৈয়াছড়া ঝর্ণার ১৩ টি ধাপ যেন একেক রকম মুগ্ধতার পসরা সাজিয়ে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে ব্যস্ত। ঝর্ণার সবগুলো ধাপ দেখতে বেশ সময় লাগে তাই একদিনের ভ্রমণে আপনার আর কোন স্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা না থাকলে অন্য ধাপগুলো দেখার চেষ্টা করতে পারেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই যথেষ্ট শারীরিক সামর্থ্য দরকার। আর চাইলে ঝর্ণায় যাবার পথে স্থানীয় খাবারের হোটেলগুলোর কোন একটিতে আপনার পছন্দের খাবারের অর্ডার করে যেতে পারবেন।
যদি খৈয়াছড়া ঝর্ণার এক বা দুইটি ধাপ দেখে চলে আসেন সেক্ষেত্রে ফিরে আসার সময় স্থানীয় হোটেলগুলোতে দুপুরের খাবার খেয়ে সীতাকুণ্ডে ফিরে আসুন। অথবা হাতে সময় থাকলে খৈয়াছড়ায় খাবার না খেয়ে সীতাকুণ্ড বাজারে খাবার খেতে পারেন। দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ুন সীতাকুণ্ড থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে থাকা প্রকৃতির আরেক বিস্ময় গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। সীতাকুন্ডের বাস স্ট্যান্ড ব্রীজের নিচ থেকে সরাসরি সিএনজি/অটো নিয়ে গুলিয়াখালি বীচের বাঁধ পর্যন্ত চলে যেতে পারবেন। একদিকে সবুজ ঘাসের সৈকত আর অন্য দিকে উত্তাল সাগরের গর্জন এখানে মিলেমিশে একাকার। আর গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত দেখে যেকোন সৌন্দর্য প্রেমী মানুষ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
গুলিয়াখালীর রূপ দেখে সীতাকুণ্ডে ফিরে আসুন। সীতাকুণ্ড হতে ঢাকায় আসার প্রায় সকল পরিবহণের বাস পাবেন। আর যদি ট্রেনে ঢাকা ফিরতে চান তবে ট্রেনের সিডিউলের সাথে সময় মিলিয়ে চলে আসুন ফেনী রেলওয়ে ষ্টেশনে। আর যদি আপনার গন্তব্য অন্য কোথাও হয় তাহলে যেভাবে গেলে সবচেয়ে ভাল হবে চলে যান আপনার গন্তব্যে।
ভ্রমণ খরচ
এই ডে ট্রিপে কত খরচ হবে তা স্বাভাবিক ভাবেই আপনি বা আপনাদের উপরেই নির্ভর করবে। খাওয়া দাওয়া এবং যাতায়াতই মূলত এই ট্রিপের মূল খরচ। আর একসাথে গ্রুপ করে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই খরচ কিছুটা কমে যাবে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়ার সময় লোকাল সিএনজি/টমটম/ইজিবাইক ব্যবহার করলেও খরচ কম লাগবে। এছাড়া আপনারা যদি একসাথে ৪-৫ জন হন তাহলে যাতায়াতের জন্যে সিএনজি রিসার্ভ করে নিতে পারেন, এতে সময় বেঁচে যাবে। ঢাকা থেকে ঘুরে দেখার একটা আনুমানিক খরচের হিসেব নিচে দেওয়া হলো। এবং ধরে নিচ্ছি আপনারা একসাথে ৪-৫ জন ভ্রমণ করতে যাবেন। এখান থেকে ধারণা করতে পারবেন কেমন খরচ হতে পারে।
কম খরচে ও বাজেট ভ্রমণ করতে চাইলে:
ঢাকা নন এসি বাসে যাওয়া ও আসা – ৪৫০ x ২ = ৯০০ টাকা জনপ্রতি
সকালের নাস্তা = ৫০ টাকা জনপ্রতি
দুপুরের খাবার = ১২০ টাকা জনপ্রতি
জায়গা গুলোতে যাতায়াত = ২০০ টাকা জনপ্রতি (৪ জন গ্রুপ হিসেবে)
অন্যান্য টুকিটাকি খরচ = ১০০ টাকা
তাহলে সর্বমোট খরচ জনপ্রতি ১৩৫০ টাকা। সময় অবস্থা এবং আপনাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই খরচ কম বেশি হতে পারে। যেমন চাইলে খাওয়া দাওয়ার জন্যে আপনি যেমন আরও বেশি খরচ করতে পারবেন তেমনি চাইলে আরও কমাতেও পারবেন। ট্রেনে গেলে যাওয়া আসার খরচ ও কমে যাবে (যদিও ট্রেনে যাওয়া আসা করতে গেলে কষ্ট হবে)। আরামে যেতে চাইলে এসি বাসেও যাওয়া আসা করতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই খরচ বেড়ে যাবে।
সতর্কতা
পাহাড় ও ঝর্ণা ভ্রমণে অবশ্যই আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। পাহাড়ে উঠার জন্যে এবং ঝর্ণার ট্রেইলে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট মানসিক ও শারিরিক শক্তি থাকা প্রয়োজন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ও ঝর্ণায় ছোট বাচ্চা কিংবা বয়স্ক কাউকে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। প্রতিটি জায়গা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য ও পরামর্শ জানার জন্যে সেই জায়গা গুলোর ভ্রমণ গাইড পড়ে নিন।
সাইফ/অননিউজ টুয়েন্টিফোর