কাউন্সিলর সোহেলসহ জোড়া খুন: যেভাবে এলো অত্যাধুনিক অস্ত্র !
কুমিল্লা প্রতিনিধি।।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ মো. সোহেল ও তার সহযোগী হরিপদ সাহা হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে কেনা হয় অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। আর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকেই কিলিং মিশনের পরিকল্পনা করা হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে শুধু এতটুকু দাবি করা হচ্ছে, আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জের ধরে সোহেলকে হত্যার পরিকল্পনা করে প্রধান আসামি শাহ আলম। প্রশ্ন উঠেছে, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত এতগুলো অস্ত্র কে দিল? শাহ আলমের মতো দরিদ্র কীভাবে কোথা থেকে অতাে টাকা পেল?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে শাহ আলমকে মূল সন্দেহভাজন বলা হলেও দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানাযাচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের জন্য অস্ত্র কিনতে তাকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেয় মো. সোহেল ওরফে জেল সোহেল। এরই মধ্যে ২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দিয়ে তিনটি অস্ত্র কেনা হয়। বাকি ১৮ হাজার টাকা শাহ আলমের কাছে ছিল।
এসব তথ্য জানার পর প্রশ্ন ওঠে, জেল সোহেলও দরিদ্র, তাকেই বা কে এত টাকার যোগান দিয়েছে। কে তিনি? সে ক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় এসেছে একজন কাউন্সিলরের নাম, যার দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত ছিল সোহেল। সেই কাউন্সিলর আবার ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
হত্যা মিশন সফল হওয়ার পর নতুন কেনা তিনটি অস্ত্র শাহ আলমকে ‘উপহার’ দেওয়ার কথা দেয় জেল সোহেল।
তদন্তসংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, নিহত কাউন্সিলর সৈয়দ মো. সোহেলের সঙ্গে শাহ আলমের দুটি বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল। এজন্য শুধু তিন অস্ত্রের বিনিময়ে তাকে ভাড়া করা সম্ভব হয়। নতুন কেনা তিনটি অস্ত্র শাহ আলমকে ‘উপহার’ দেওয়ার কথা দিয়েছিল জেল সোহেল।
ওই কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় কুমিল্লার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন বাবুলের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গতকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ।তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মামলার বাদী ও নিহত কাউন্সিলর সোহেলের ছোট ভাই সৈয়দ মো. রুমন বলেন, ‘যারা মূল পরিকল্পনাকারী তারাই তো অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে, তারা কারা? এদের নাম জানতে চাই। যারা ধরা পড়েছে তারা তো শুধু ভাড়াটে খুনি।’
এ ছাড়া আরও চারজন গুলিবিদ্ধ হন। পরে সোহেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি শাহ আলম এবং অন্য আসামি সাব্বির ও সাজন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। মামলার বাদীসহ অনেকের অভিযোগ, যারা ইন্ধনদাতা, সুবিধাভোগী এবং শাহ আলম ও সোহেলের পেছনে রয়েছে, তাদের আড়ালে রাখা হচ্ছে। তদন্ত সোহেল ও শাহ আলম পর্যন্ত রাখবে।
রুমন আরোও বলেন, ‘আমার ভাই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে কাউন্সিলর হয়েছিলেন। প্যানেল মেয়র ছিলেন। সামনে নির্বাচন। তার জন্য মেয়র পদে মনোনয়ন পাওয়ার সুযোগ ছিল। কেউ পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছিল কিনা বের হওয়া জরুরি।’ কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে এজারহারভুক্ত ১১ আসামির ১০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এজাহারের বাইরে দু’জনকে ধরা হয়। এই হত্যার সঙ্গে আর কারও সংশ্নিষ্টতা আছে কিনা সেটা নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কেউ মারা গেলে তো আমাদের কিছু করার নেই।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সাহান সরকার বলেন, পূর্বশত্রুতা ও আধিপত্য নিয়ে বিরোধের জের ধরে কাউন্সিলরকে হত্যা করে শাহ আলম। অন্য সন্দেহজনক কিছু থাকলে তা তদন্ত কর্মকর্তা দেখছেন। দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, এ মামলায় জেল সোহেলসহ এজাহারভুক্ত ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও তারা অনেক তথ্য দিয়েছে।
তাদের ভাষ্য, একই এলাকার বাসিন্দা এবং একসময় একসঙ্গে কারাগারে থাকার কারণে শাহ আলম ও জেল সোহেলের মধ্যে সখ্য ছিল। জেল সোহেলই শাহ আলমকে পরিকল্পনা দেয়, কাউন্সিলর সৈয়দ সোহেলকে ‘সরাতে’ হবে। তখন শাহ আলম জানায়, তার কাছে একটি অস্ত্র আছে। মিশন সফল করতে হলে আরও অন্তত তিনটি অস্ত্র লাগবে। এরপর শাহ আলমকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করতে বলে জেল সোহেল।
শাহ আলম অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় ফেনীর বাসিন্দা তার ঘনিষ্ঠ নিশাতকে। পরে নিশাত এক পাহাড়ি অস্ত্র কারবারির কাছ থেকে তিনটি ৭.৬৫ বোরের ভারতীয় পিস্তল ও ৫০ রাউন্ড গুলি কেনে। ওই পাহাড়ি খাগড়ছড়ি থেকে অস্ত্রগুলো এনে নিশাতের হাতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁঁছে দেয়। এরপর সেই অস্ত্র আসে শাহ আলম পর্যন্ত। হত্যা মিশনের নিশাতসহ সরাসরি যে ছয়জন ছিল তারা হলো- শাহ আলম, জেল সোহেল, সাজন ওরফে সার্জেন, নাজিম ও মো. সাব্বির হোসেন। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে চারটি ছোট অস্ত্র হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার হয়। এর মধ্যে একটি রিভলবার ও তিনটি পিস্তল। এর মধ্যে তিনটি অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, কাউন্সিলর সৈয়দ সোহেলের সঙ্গে একসময় প্রধান আসামি শাহ আলমের সখ্য ছিল। তবে কয়েকটি ঘটনায় তাদের মধ্যে সখ্য তৈরি হয়। বছর দশেক আগে শাহ আলমের বাবা জানু মিয়া বিদেশ থেকে কুমিল্লায় ফেরেন। তিনি মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, এ কারণে মাদক কারবারিরা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এর জের ধরে জানু মিয়াকে হত্যা করা হয়। জানুর ছেলের বিশ্বাস ছিল, তার বাবার হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন ছিল কাউন্সিলরের।
কারণ যে গ্রুপটি জানু মিয়াকে হত্যা করে বলে অভিযোগ ওঠে, তার সঙ্গে কাউন্সিলরের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। পরে জানু মিয়া হত্যায় জড়িতদের খুন করার মামলায় শাহ আলম কারাভোগ করে। জেলে থাকা অবস্থায় এই মামলার অন্য আসামিরা শাহ আলমকে জানায়, জানু মিয়াকে যে অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছে সেটি সরবরাহেও কাউন্সিলরের হাত আছে। এটি বিশ্বাস করে কাউন্সিলরের প্রতি তার ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। পরে জেল থেকে বেরিয়ে এসে কাউন্সিলরের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলত সে। এরই মধ্যে কাউন্সিলর সৈয়দ সোহেলকে হত্যার আয়োজন করে একটি প্রভাবশালী চক্র।
দীর্ঘদিনের সেই ক্ষোভ থেকেই জেল সোহেলের প্রস্তাব গ্রহণ করে কাউন্সিলর হত্যা মিশনে জড়ায় শাহ আলম। হত্যাকাণ্ডের পর কিছু অস্ত্র ও হাতবোমা বস্তায় ভরে মামলার ৮ নম্বর আসামি জিসানের মামাতো ভাই ইমরান খন্দকারের সুজানগর এলাকার বাসায় রেখে দেওয়া হয়। আর কিছু অস্ত্র শাহ আলম কুমিল্লায় জাহাঙ্গীর নামে নিরাপদ এক মুদি দোকানির বাসায় রাখে। পরে ভয়ে জাহাঙ্গীর ওই অস্ত্রের ব্যাগসহ তার স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
জানা যায়, জেল সোহেলের সঙ্গে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাবুলের সখ্য ছিল। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কাউন্সিলর বাবুল নাকি তার পেছনে আরোও কেউ রয়েছে। কারণ বাবুল কুমিল্লার স্থানীয় সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতার ‘কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত। আসন্ন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের কোনো হিসাব-নিকাশ এই হত্যার পেছনে রয়েছে কিনা এমন আলোচনাও আছে। কারণ, সোহেল এলাকায় জনপ্রিয়। জনশ্রুতি আছে, আগামী সিটি নির্বাচনে তিনি শক্ত মেয়র প্রার্থী হতেন।
আসছে নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর হওয়ার আলোচনায় আরও আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া রয়েছেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খানের মেয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমা, তার ভাই এফবিসিসিআই পরিচালক মাসুদ পারভেজ খান, মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সাবেক ভিপি নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম। আর বিএনপি থেকে আলোচনায় আছেন বর্তমান মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাউছার জামান বাপ্পী।
আয়েশা আক্তার/অননিউজ24