জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেখা দিয়েছে তীব্র খরা যার অন্যতম কারণ কার্বন নিঃসরণ। যা কিনা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। ফলে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার কথা। অথচ ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছরেই বাংলাদেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ২.৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, বাংলাদেশের প্রধান পাঁচটি শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান হার বজায় থাকলে ২০৫০ সালে শহরগুলো মানুষের বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পরবে।
খরা কেন হচ্ছে এ বিষয়ে পরিবেশবিদ অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, খরা হয় তাপমাত্রা যখন বেড়ে যায়, তাপমাত্রার সাথে যখন বাষ্পীয় ভূবনে ইভুলেশন হয়। তাছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অংশ হিসেবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং যেটা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যেটার ইম্প্যাক্ট হিসেবে বাংলাদেশেও উষ্ণতায়নের প্রভাব আছে। তাছাড়াও দেখা যায় স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন পরিবর্তন হচ্ছে, নগরায়ন এবং শিল্পায়নের প্রচুর পরিমাণ তাপমাত্রা উৎপন্ন হচ্ছে। শিল্প এবং নগরে বিভিন্ন যানবাহন থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনযাপন সব জায়গা থেকে তাপমাত্রা তৈরি হচ্ছে! ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের জলধারের পরিমাণ কমে যাচ্ছে! জলাধার কমে যাওয়ার কারনে জলভূমি থেকে যে বাষ্পীয়র মাধ্যমে আবহাওয়াকে ঠান্ডা রাখত সেই জায়গায় আমরা নেগেটিভ দিকে যাচ্ছি। অর্থাৎ ঠান্ডার পরিমাণ কমছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের যে সবুজের পরিমাণ আছে সেটা কিন্তু কমে যাচ্ছে! অর্থাৎ বিশেষ করে বৃক্ষের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বৃক্ষ দুটি ভাবে আমাদের শীতল রাখত। প্রথমত হল সূর্যের আলোকে রিফ্লেক্ট করে নিত। রিফলেক্ট করার কারণে বৃক্ষ নিজে গরম হত না ফলে সূর্যের আলো যখন শেষ হয়ে যেতো ওই বৃক্ষ তখন জায়গাকে শীতল করে দিত। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে একই সাথে বৃক্ষ সালোসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে পানি তৈরি করে তখন এই পানিটা জলীয় বাষ্প হয়ে ওই এলাকাটিকে শীতল করে দিত। যেহেতু বৃক্ষের পরিমাণ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ফলে ওইসব এলাকা গুলি আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে আমরা একটা গবেষণা করে দেখেছি যেসব এলাকায় বৃক্ষের পরিমাণ বেশি সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। আর যেসব জায়গায় বৃক্ষ কম সেসব এলাকায় তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি পরিমাণে বেশি।
২০১৫ সালে প্যারিস সম্মেলনে বলা হয়েছিল যারা সব থেকে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করছিল যেমন, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরা যে কমিটমেন্ট করেছিল যে তারা আস্তে আস্তে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে নিয়ে আসবে তারা কি এখন কমিটমেন্ট ব্রেক করেছেন কোন ভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে মি. মজুমদার বলেন, প্রথমত হলো যে, তাপমাত্রা কমানোর জন্য তাদেরকে খুব বেশি প্র্যাকটিক্যাল এবং সাসটেনেবল ভিসিবল আগ্রহ আমরা দেখি না। কারণ তারা কেউই কিন্তু তাদের প্রোডাকশন কমিয়েছে এরকম কোন বক্তব্য শুনি নাই। এবং দেশে এখন পর্যন্ত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করেছে তাদের অনেক জায়গায় বৃক্ষ ধ্বংস করেছে অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে বলনারেবল দেশগুলোর জন্য প্রতিবছর প্যারিস এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। সে জায়গায়ও আমরা কোন রকম ক্ষতিপূরণ লক্ষ্য করি না। আগ্রহ মুখে আছে কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল দেখিনা।
এদিকে চীন ৭ বছর আগে, প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে জানিয়েছিল— বিশ্বের তাপমাত্রার বিপজ্জনক বৃদ্ধি ঠেকাতে তারা কার্বন নির্গমন কমাবে। কিন্তু এখনই তা নয়। কারণ, কার্বন নির্গমন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাবে ২০৩০ সালে। দেশটির লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের শক্তি উৎপাদনের ২৫ শতাংশ আসবে ফসিলজাত নয় এমন জ্বালানি থেকে। চীন অঙ্গীকার করছে, ২০৬০ সালের মধে তারা আর কার্বন নিঃসরণ করবে না হয়ে যাবে ‘কার্বন-নিরপেক্ষ’।
পৃথিবীর সমগ্র কার্বন নিঃসরণের এক-চতুর্থাংশই করে চীন। প্রধানত কয়লানির্ভরতার কারণে তাদের কার্বন নিঃসরণ এখনো বাড়ছে। চীন যে কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার কথা বলছে— তা কি নিঃসরণ কাটছাঁটের মাধ্যমে, নাকি অন্য কোনো পন্থায় হবে— তা তারা এখনো স্পষ্ট করেনি।
কয়েক বছর আগেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা করেছেন, তারা বিদেশে আর কোনো নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়ন করবেন না। কিন্তু দেশের ভেতরে কয়লাখনিগুলোকে আদেশ দেয়া হয়েছে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যাতে চীন জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারে, যদিও তারা ২০২৬ সাল থেকে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর অঙ্গীকার করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটিয়েছে চীন। পৃথিবীতে যত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হচ্ছে চীনে, আর বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনে চীন এখন পৃথিবীতে এক নম্বর।
যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, মাথাপিছু সর্বোচ্চ ১৫.৫ টন কার্বন নিঃসরণকারী তারা। তাদের, অঙ্গীকার ২০৩০ সালের মধ্যে ২০০৫-এ যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করত তার অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। দেশটি চাইছে ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে নতুন গাড়ির অর্ধেকই হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি। ২০৫০ সালের মধ্যে তারা কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার অঙ্গীকারও করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ফসিলজাত জ্বালানি হচ্ছে ৮০ শতাংশেরও বেশি শক্তির উৎস। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের পরিমাণ এখন বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পরিবেশসংক্রান্ত পরিকল্পনা সবুজ জ্বালানির আওতা আরো বৃদ্ধি করছে। অন্তত ১৫ হাজার কোটি ডলারের ক্লিন ইলেকট্রিসিটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে— যা দিয়ে ফসিল জ্বালানি পরিত্যাগকারী কোম্পানিগুলোকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা এতে বাধা দিচ্ছেন। এরা উদ্বিগ্ন যে এ কর্মসূচি কয়লা ও ফ্র্যাকিং শিল্পের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
তবে, খানিকটা আশাপ্রদ ব্যাপার হলো— গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কার্বন নিঃসরণ কমতে শুরু করেছে।
নিঃসরণ কমছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে: ইইউ অঙ্গীকার করেছে ১৯৯০-এর স্তর থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ কমানো হবে। তারা লক্ষ্য স্থির করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ জ্বালানি আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার অঙ্গীকারও করেছে তারা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো হচ্ছে জার্মানি, ইতালি এবং পোল্যান্ড। কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য ইইউর একটি সার্বিক লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এর সদস্য দেশগুলোর আর্থিক এবং কারিগরি সক্ষমতা এক রকম নয়।
এদিকে দায় এড়াতে চায় ভারত: ভারতের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণের মাত্রা শতকরা ৩৩ থেকে ৩৫ ভাগ কমিয়ে আনা। প্যারিস সম্মেলনে দেশটি অঙ্গীকার করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের বিদ্যুৎ শক্তির ৪০ শতাংশ আসবে ফসিলজাত নয়— এমন জ্বালানি থেকে। তবে, কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার কোনো লক্ষ্যমাত্রা এখনো ঘোষণা করেনি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশটি। ভারতের বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ গত দুই দশকে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে ভারতেরই মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের মাত্রা সবচেয়ে কম। ভারত যুক্তি দিচ্ছে যে অপেক্ষাকৃত ধনী এবং অধিক শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই নিঃসরণ কমানোর দায়িত্ব বেশি করে নিতে হবে। কারণ বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ দেশগুলোই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে।
ভারত ‘নিঃসরণের মাত্রা’ বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এককপ্রতি কার্বনের একটা লক্ষ্য স্থির করেছে। তারা বলছে, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তাদের তুলনার জন্য এটি একটি অধিকতর ন্যায়সঙ্গত মাপকাঠি। বায়ু, সৌর এবং জলশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানোরও অঙ্গীকার করেছে ভারত এবং ৩ বছর আগেই এর পরিমাণ ২৩ শতাংশ পৌঁছেছে। কিন্তু ভারতের বিদ্যুতের প্রায় ৭০ শতাংশই এখনো কয়লাভিত্তিক।
কথা রাখা কঠিন রাশিয়ার: রাশিয়ার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল ও গ্যাস। পরিস্থিতিগত কারণে রাশিয়ার পক্ষে কার্বন নিঃসরণ কমানো সবচেয়ে কঠিন। তারপরেও তারা ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন ৩০ শতাংশ কমানোর কথা বলেছে এবং অঙ্গীকার করেছে, ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি ও কার্বন নিঃসরণ সংকুচিত হয়েছিল। কিন্তু তারা এখনো কার্বন শোষণের জন্য তাদের বিশাল বন ও জলাভূমির ওপর নির্ভর করছে।
তাদের জ্বালানির যে অংশটুকু বায়ু, সৌর ও জলশক্তির মতো অ-ফসিলজাত উৎস থেকে আসে সেটির পরিমাণ বেশ কম। অন্যদিকে তাদের জিডিপির ২০ শতাংশেরও বেশি আসে ফসিলজাত জ্বালানি থেকে।
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি বাংলাদেশের: আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর আগামী কয়েক বছরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। গবেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী— এই চারটি জেলা শহরে রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, ফলে সবসময় গরম অনুভূত হবে।
নগরবিষয়ক সুপরিচিত এক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘সাসটেইনেবল সিটিজ অ্যান্ড সোসাইটি’তে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে, ভূ-উপগ্রহ থেকে পাওয়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট— এই পাঁচটি শহরের দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ধরন বিশ্লেষণ করে গবেষণা চালানো হয়। এর মধ্যে ছিল প্রতিদিনের দুটো তথ্য- দুপুরের ও রাতের তাপমাত্রা। প্রায় আট হাজার স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে এই গবেষণায়। গবেষণায় বলা হয়েছে নগরাঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কারণ আগামী ৩০ বছর অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ নগরে বসবাস করবে।
গবেষকরা ধারণা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছর পরে বড় বড় শহরের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
একই অবস্থা হয়েছে আরো তিনটি শহরে— বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বেড়েছে ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি, খুলনায় ১ দশমিক ২৭, সিলেটে ১ দশমিক ১, রাজশাহীতে বেড়েছে সবচেয়ে কম— শূন্য দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির পেছনে এর জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলাকেই দায়ী করা হয়েছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, রাতের চট্টগ্রামের তাপমাত্রা রাজধানী ঢাকার রাতের তাপমাত্রার চেয়েও বেড়েছে।