কুমিল্লায় একের পর এক কিশোর অপরাধের ভয়াবহতার রেশ কাটতে না কাটতেই কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা তান্ডব চালায় অন্য এক অপরাধে, যা এখন শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নেই, শহর ছাড়িয়ে এখন এর ভয়াবহতা গ্রামে ছড়িয়েছে। গত বছরের আগষ্ট মাসে কুমিল্লার ধর্মসাড়ের পাড়ে রবিউল হাসান শাহাদাত নামে এক কিশোর খুনের ঘটনায় রতন গ্রুপের সদস্যদের নামে মামলা হবার পর থেকে কুমিল্লায় আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। প্রসাশনের যথেষ্ট নজরদারির পরেও শহর ছাড়িয়ে এখন তা গ্রামের ছড়িয়েছে বিপুল মাত্রায়।
সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লার বুড়িচং থানার ৪নং ষোলনল ইউনিয়নের পূর্বহুড়া গ্রামে এর ভয়াবহতা দৃশ্যমান। এলাকায় চুরি ডাকাতি থেকে শুরু করে মারামারি হানাহানি সহ কিশোর অপরাধের মাত্রা কিছুতেই কমছে না এই এলাকায়। কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে ফেসবুকে গ্যাং গ্রুপের ছবি দিয়ে নিজেদের আধিপত্য জানান দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এলাকায় বিগত বছরগুলোতে অসংখ্য চুরি ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনার বিচার না হওয়ার কারনে পাশাপাশি প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে কিশোর অপরাধের মাত্রা বর্তমানে চরম আকার ধারন করেছে এবং এর প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে দিনের পর দিন।
দু একজন বাদে স্থানীয় কিশোর অপরাধীদের প্রায় সকলের বয়স ১৩ থেকে ১৬ বছর, সংঘবদ্ধ এই অপরাধীদের বেপরোয়া আচরনে এলাকায় ভীতিকর অবস্থা থাকে প্রতিনিয়ত। সাধারন মানুষ ভয়ে আতংকিত থাকে বিধায় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা অপরাধিরা সব সময় ধরা ছোয়াঁর বাহিরে থাকলেও ব্যাতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে গত ৭ তারিখে ঘটে যাওয়া অপরাধে। অসংখ্য অপরাধে ছাড় পেলেও দীর্ঘদিন পর এই একটি মাত্র অপরাধে মামলা করেন ভিকটিমের মা শামীমা আক্তার।
মামলার এজাহারে দেখা যায় এলাকায় কিশোর গ্যাং এর অন্যতম সক্রিয় সদস্য পূর্বহুড়া তহশীলদার বাড়ীর শাহ আলমের পুত্র মো: রিয়াদ হোসেন, আবুল খায়ের এর পুত্র মো: সিয়াম এবং জরকিন আলীর পুত্র মো: জিসান সহ কিশোর গ্যাং এর আরো কয়েকজন সদস্য সংঘবদ্ধ হয়ে একই গ্রামের আমজাদ আলীর বাড়ীর কামাল হোসেন এর নাবালক পুত্র মো: রিয়াদ হোসেন এর উপর অতর্কিত হামলা চালায়, এ সময় উপর্যপুরী রডের আঘাতে সাইফ এর সারা শরীরে আঘাত প্রাপ্ত হয় পাশাপাশি তার ডান হাটুর হাড় ভেঙ্গে যায় বলে জানা যায়, আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে বুড়িচং হাসপাতালে নেয়া হয়, এক্সরে করার পরে তাহার পায়ের হাড় ভাঙ্গার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ঘটনার পর এসব গ্যাং নিয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রামটিকে অনিরাপদ মনে করছেন বাসিন্দারা, এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে সমালোচনা।
খবর নিয়ে জানা যায় ঘটনার সূত্রপাত হয় পূর্বহুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে কালচারাল প্রোগ্রামে। সেদিন স্কুলের অনুষ্ঠানে স্থানীয় মেম্বার নজরুল ইসলামের উপস্থিতিতে মামলার ৩নং বিবাদী মো: জিসান কোন কারন ছাড়াই সাইফ এর উপর হামলা চালায়। এ সময় সাইফের অনুসারীরা উক্ত হামলার প্রতিবাদ জানায় এবং পাল্টা হামলা চালানোর চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে ধস্তা ধস্তির ঘটনা ঘটে, পরবর্তিতে বিষয়টি সমাধান না হওয়ায় প্রতিশোধ নিতেই জিসান ও তার দলের অন্য সদস্যরা মিলে সাইফকে মারার পরিকল্পনা করে। এ সময় একই এলাকার আবুল কাশেমের বাড়ীতে বেশ কয়েকদিন ধরে সাইফ রাজমিস্ত্রির সাথে হেলপার হিসাবে কাজ করে আসছিল যা জিসান ও তার দলের সদস্যরা অনুসরন করতে থাকে। সবশেষ সুযোগ করে গত ৮ তারিখ কিশোর গ্যাং এর অন্যতম সদস্য রিয়াদ এর নেতৃত্বে ৪/৫ জনের সংঘব্ধ দল আবুল কাশেমের বাড়ীতে গিয়ে সাইফ এর উপর আতর্কিত হামলা চালায়, এ সময় বেলচা ও রডের উপর্যপুরী আঘাতে সারা শরীরে জখম ও পায়ের হাটুতে হাড় ভেঙ্গে যায়, স্থানীয়দের সহযোগীতায় আশংকাজনক অবস্থায় তাকে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ ভর্তি করা হয়। হাড় ভাঙ্গা পা এবং শরীরে জখম নিয়ে বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে।
এই বিষয়ে, বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মীর হোসেন মিঠু জানান, হাসপাতালে অন্য রুগীর পাশাপাশি সাইফ নামে একজন রোগী ভর্তি আছে বলে তিনি জানেন এবং হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাকে চিকিৎসা সেবাও দেয়া হচ্ছে, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে যতটুকু সম্ভব সাধ্যমত চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেষ্টা করবেন।
সাইফ এর উপর হামলার বিষয়ে ভিকটিমের মা সালমা আক্তার এবং এজাহারে উল্লেখিত ৪নং স্বাক্ষী মো: সোলেমান সহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একাধিক ব্যাক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, উল্লেখিত ঘটনার সাথে এজাহারে উল্লেখিত ৩জন ছাড়াও অজ্ঞাত নামা বেশ কয়েকজন রয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকে নাবালক হওয়ার কারনে মামলায় নাম দেয়া সম্ভব হয়নি। তারা আরও জানায় একই গ্রামের নীল মিয়ার ছেলে জুয়েল এবং ভূইঁয়া বাড়ীর জসিম মেম্বারের ছেলে ফয়সাল এর নেতৃত্বে এলাকায় কিশোরদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা অব্যাহত আছে, বিষয়টি এখন ওপেন বলেও জানা যায়, ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রভাব ও গ্যাং পরিচিতি সুষ্পষ্ট করে আসছে বলেও জানা যায়, তাদের চলমান অনাচার ও বেপরোয়া কর্মকান্ডের কারনে অনেকর পিতা তাদের নাবালক সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকা প্রকাশ করছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের এমন কর্মকান্ডে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ, অভিযোগে আরো জানা যায়, আধিপত্য বিস্তার করতে পার্শ্ববর্তী গ্রাম ভান্তি ও কোশাইয়ামের একাধিক ব্যাক্তিকে মারধর করা সহ পূর্বহুড়া পূর্বপাড়ার মৃত হাসেম মিয়ার নাবালক ছেলে তপুকেও ওরা পিটিয়ে আহত করেছে, ওদের হিংস্রতা এতটাই বেশী যে, এই পর্যন্ত উল্লেখিত কিশোরদের বিচার করা সম্ভব হয়নি। এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায় এলাকায় চুরি ডাকাতি সহ এমন কোন অপরাধ বা অসাধু কর্মকান্ড নেই যা এই কিশোরদের দ্বারা সংগঠিত হয়নি। এই অভিযোগের বিষয়ে বিবাদি গণের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাদের খুজে পাওয়া যায়নি।
বিচারহীনতায় ক্রমাগত কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি ও বর্তমান ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় বর্তমান মেম্বার নজরুল ইসলাম এবং সাবেক মেম্বার তফাজ্জল হোসেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিষয়টি তারা চেয়ারম্যানকে অবহিত করেছেন এবং সামাজিক ভাবে বিষয়টি সমাধান করা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে ষোলনল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী বিল্লাল হোসেন জানান, বিষয়টি তিনি অবহিত হয়েছেন এলাকাবাসীর সহায়তায় তিনি এ বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগ নিবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
মামলার বিষয়ে বুড়িচং থানার এস আই ও এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, মামলায় এ পর্যন্ত দুই জনকে আটক করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এমন অপরাধ চলমান থাকলেও এলাকায় কিশোর অপরাধের বিষয়ে স্থানীয় লোকজন এই মামলা হওয়ার পূর্বে কেউ কোন অভিযোগ করেনি এমনকি মোবাইল ফোনেও তাকে কোন অভিযোগ বা অপরাধের তথ্য জানায়নি। এই মামলাটি হাতে পাওয়ার পর বেশ কিছু অভিযোগ তিনি পেয়েছেন। কিশোর অপরাধ দমনে তিনি এলাকাবাসীর সহযোগীতা কামনা করেন পাশাপাশি উল্লেখিত মামলার আসামীদের গ্রেফতারে চেষ্টা চালাবেন বলে আশ্বস্ত করেন।