প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো কুমিল্লা নগরের উজিরদীঘি ভরাটের জন্য মেশিন বসিয়ে চার দিন ধরে পানি কমানো হচ্ছিল। খবর পেয়ে শনিবার বিকেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও আদর্শ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) দিঘির পাড়ে গিয়ে পানি তোলার মেশিন বন্ধ করে দেন। দিঘিটি কুমিল্লা সার্কিট হাউস ও জেলা পুলিশ সুপারের বাংলোর লাগোয়া।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পানি তোলে ভরাট করে ওই দিঘিতে কমিউনিটি সেন্টার, কফি হাউস ও মার্কেট করা হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘জলাধার আইনে দিঘি ও পুকুর ভরাটের কোনো সুযোগ নেই। খবর পাওয়ার পর আমরা সেটি বন্ধ করে দিই।’
কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ২২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্কালীন মুখ্য সচিব এস এ সামাদ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়, ‘কোনো অবস্থাতেই খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে খাল-বিল, পুকুর, নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয়/জলাধার বন্ধ করা যাবে না।’
কিন্তু অনুমতি না নিয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওই দিঘি ভরাটের জন্য পানি অপসারণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দিঘিটি ভরাট হলে রাজবাড়ী ও মনোহরপুরের বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একই সঙ্গে কুমিল্লা সার্কিট হাউস ও জেলা পুলিশ সুপারের বাংলোর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে একের পর এক পুকুর ও দিঘি ভরাট করে কুমিল্লা নগরের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। অবিলম্বে এই প্রক্রিয়া যেন বন্ধ করা হয়।
সরেজমিন শনিবার সকালে উজিরদীঘির পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, দিঘির অর্ধেকের বেশি পানি সেচে তোলা হয়েছে। এর দক্ষিণ পাড়ে সেচের মেশিন দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। পূর্ব পাড়ের অন্তত পাঁচজন বাসিন্দা জানান, এই দিঘির পানি তাঁরা নানান কাজে ব্যবহার করেন।
এর আগে ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল নগরের ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বাসভবন নির্মাণে শতবর্ষের পুকুর ভরাট করা হয়। এখন ওই স্থানে চলছে ‘কমলাংক’ নামের বহুতল ভবন নির্মাণকাজ। কুমিল্লা পুলিশ লাইনসের দুটি পুকুরও ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর আগে পুলিশ লাইনসের ভেতরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (সদর সার্কেল) দপ্তরও পুকুর ভরাট করে। নতুন চৌধুরীপাড়া এলাকায়ও একটি পুকুর ভরাট করা হয়। চকবাজার বাস টার্মিনালের কাছেও আরেকটি পুকুর ভরাট করা হয়। কুমিল্লা শহরতলির চানপুরের জলাধার গোমতী নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে এনে ভরাটের চেষ্টা করা হয়। তখন প্রশাসন সেটি বন্ধ করে দেয়। ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার লাকসামের কাজীপাড়া এলাকায় ১৯০ শতকের দুটি পুকুর ভরাট করা হয়। সেখানে পরে প্লট করে জায়গা বিক্রি করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নগরের ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম থেকে ১০০ গজ পূর্ব দিকে উজিরদীঘি। এর পশ্চিম পাড়ে পুলিশ সুপারের বাংলো, উত্তর পাড়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউস, পূর্ব ও দক্ষিণ পাড়ে জনবসতি। দক্ষিণ পাড়ের সড়ক দিয়ে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা ভূমি কার্যালয়, কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও রাজগঞ্জ বাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে।
দৃষ্টিনন্দন এই দিঘিতে মাছ চাষ হয়। সম্প্রতি নগরের মোগলটুলীর বাসিন্দা ব্যবসায়ী এ কে এম মহসিন এই দিঘি ক্রয় করেন। পরে তিনি এটি ভরাটের জন্য পানি কমানোর উদ্যোগ নেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে মহসিনের প্রতিবেশী মাহবুবুল আলম নামের এক ব্যক্তি চার দিন আগে দিঘির দক্ষিণ পাড়ে একটি মেশিন বসিয়ে পানি অপসারণের কাজ শুরু করেন।
খবর পেয়ে শনিবার বেলা তিনটায় পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলি ও আদর্শ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মৌসুমী আক্তার ঘটনাস্থলে যান। পরে তাঁরা পানি সেচের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।
মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দিঘিতে মাছ চাষ হচ্ছে না ঠিকমতো। পুরো দিঘি মাটি ও ময়লা-আবর্জনায় ভরে আছে। মালিকপক্ষের হয়ে আমি ওই কাজ করছি। দিঘির পাড় বাঁধার জন্য পানি কমানো হচ্ছে।’
ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন, ‘সময়ের আবর্তে কিছু পুকুর ভরাট হলেও, কখনো এই শহরের দিঘি ভরাট হয়নি। এখন দেখছি দিঘি ভরাটেরও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কুমিল্লা শহরকে বাঁচাতে হলে এখনই এটি বন্ধ করতে হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলি বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ঘটনাস্থলে গিয়ে পানি সেচের মেশিন বন্ধ করে দিই। আমরা দিঘির মালিককে নোটিশ করেছি। বিনা অনুমতিতে এভাবে দিঘির পানি কমানোর কোনো সুযোগ নেই।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক (সাক্কু) বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমার কাছে দুই ব্যক্তি এসে দিঘির পানি কমানোর কথা বলেন। তাঁরা সেখানে কফি হাউস ও পূর্ব পাড়ে রাস্তা করবেন বলে জানান। আমি তাঁদের সাফ জানিয়ে দিই, কোনোভাবেই দিঘি ভরাট করা যাবে না। দিঘিতে স্থাপনাও করা যাবে না। এরপর শুনলাম, দিঘির পানি কমানো হচ্ছে।’