কুষ্টিয়া প্রতিনিধি।।
কুষ্টিয়ায় তিন খুনের ঘটনায় করা মামলার একমাত্র আসামি বরখাস্ত হওয়া পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সৌমেন রায় (৩৫) হাইকোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। তার খোঁজ জানেন না কেউ। পরপর ছয় বার হাজিরা না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। গ্রেপ্তার এড়াতে সৌমেন রায় দেশ ছেড়েছেন বলে অভিযোগ মামলার বাদী, আইনজীবী ও এলাকাবাসীর।
২০২১ সালের ১৩ জুন আলোচিত এই হত্যাকাÐটি ঘটার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্রসহ সৌমেন রায়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন তিনি। পরকীয়ার জেরে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। এমতাবস্থায় ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর আসামি সৌমেন হাইকোর্টে থেকে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হন। এরপর থেকেই তিনি লাপাত্তা। এখন পর্যন্ত ছয় বার তাকে কুষ্টিয়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিনের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি একবারও আত্মসমর্পণ করেননি। নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২ ফেব্রæয়ারি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। তবে কুষ্টিয়া ও মাগুরা মডেল থানা পুলিশের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে কিছুই জানেন না। আসামি সৌমেন রায় মাগুরা সদর উপজেলার কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের আসবা গ্রামের সুনীল রায়ের ছেলে। তিনি সর্বশেষ খুলনার ফুলতলা থানায় এএসআই হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৩ জুন বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড় এলাকার নাজ ম্যানশন মার্কেটের বিকাশের দোকানের সামনে পরকীয়ার জেরে স্ত্রী আসমা খাতুন (২৫), আসমার ছেলে রবিন (৫) এবং আসমার পরকীয়া প্রেমিক শাকিলকে (২৮) সরকারি অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন এএসআই সৌমেন রায়। এ ঘটনায় পুলিশ তাকে ঘটনাস্থল থেকে সার্ভিস রিভলভার, গুলি ও ম্যাগাজিনসহ আটক করে। সেদিন বিকেলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। একইদিন রাতে এএসআই সৌমেন রায়কে একমাত্র আসামি করে হত্যা মামলা করেন নিহত আসমা খাতুনের মা হাসিনা বেগম। পরদিন ১৪ জুন বিকেলে কুষ্টিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. এনামুল হকের আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সৌমেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশিকান্ত সরকার তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন সৌমেন রায়। এরপর কুষ্টিয়া আদালতে বারবার আত্মসমর্পণের দিন ধার্য থাকলেও তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় ২০২৩ সালের ২ ফেব্রæয়ারি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সাত মাস পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি জানেন না সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তারা। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।
মামলার বাদী হাসিনা বেগম বলেন, আমার মেয়ে, তার ছেলে রবিন ও শাকিল নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে সৌমেন। সে হাইকোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে ভারতে পালিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে শুনেছি সে ভারতে পালিয়েছে। এমন নির্মম হত্যাকান্ডের একমাত্র আসামিকে জামিন দেওয়ায় আমি হতাশ। তিনজনকে হত্যা মামলার একমাত্র আসামির জামিন হলো কীভাবে। আমি সৌমেনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হোক, দ্রæত মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অনুপ কুমার নন্দী বলেন, তিনজনকে গুলি করে হত্যা মামলাটি আর্গুমেন্ট পর্যায়ে রয়েছে। একমাত্র আসামি সৌমেন হাইকোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে পলাতক। পলাতক আসামির অনুপস্থিতিতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পরপর কয়েকবার আদালতে হাজিরা দেয়নি সে। এখন সে ওয়ান্টেড, তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। পুলিশের নলেজে আছে বিষয়টি।
কুষ্টিয়া ও মাগুরা মডেল থানা পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে কিছুই জানে না। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আশিকুর রহমান বলেন, পরকীয়ার জেরে তিনজনকে গুলি করে হত্যা মামলার একমাত্র আসামি সৌমেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়ে গেছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি জানা নেই। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে সৌমেনের স্থায়ী ঠিকানায়।
মাগুরা সদর থানার সেকেন্ড অফিসার হাফিজুর রহমান বলেন, মাগুরা থানায় সৌমেনের বিরুদ্ধে কোনো ওয়ারেন্ট পেন্ডিং নেই। কোথাও হয়তো আটকে থাকতেও পারে। সৌমেন নামের কোনো আসামির ওয়ারেন্ট পেন্ডিং নেই। ওয়ারেন্ট রেজিস্ট্রার চেক করে এ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ পেলে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করবো।
এ বিষয়ে পলাতক সৌমেনের পরিবারের লোকজনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় লোকজন জানান, তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনার পর সৌমেনকে এলাকায় দেখা যায়নি কখনো। তবে গুঞ্জন শোনা যায় সৌমেন জামিন নিয়ে ভারতে পালিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, কুমারখালী থানায় দায়িত্বে থাকার সময় এএসআই সৌমেনের সঙ্গে একটি মামলাকে কেন্দ্র করে আসমার পরিচয় হয়। পরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সময় সৌমেন তার নাম মো. সুমন হোসেন রাখেন এবং সুমন নামেই মুসলিম বিধান মতে আসমাকে বিয়ে করেন। সৌমেন আসমার তৃতীয় স্বামী ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই কুষ্টিয়ার আড়ুয়াপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় তারা বাস করছিলেন।
এএসআই সৌমেন খুলনার ফুলতলা থানায় বদলি হওয়ার পর থেকেই বিকাশকর্মী শাকিলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান আসমা। এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি সৌমেন। আসমার প্রতি ক্ষোভ জমিয়ে রাখেন মনে। সেই ক্ষোভ থেকেই দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন সৌমেন। নিহতরা হলেন এএসআই সৌমেনের স্ত্রী আসমা, আসমার দ্বিতীয় স্বামীর ছেলে রবিন এবং পরকীয়া প্রেমিক শাকিল।
সৌমেন রায় ২০১৫ সালে কনস্টেবল থেকে এএসআই পদে উন্নীত হন। পরে ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় যোগ দেন। সেখান থেকে মিরপুর থানার হালসা ক্যাম্প, বাগেরহাট থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ খুলনার ফুলতলা থানায় কর্মরত ছিলেন।
এফআর/অননিউজ