গ্রামটিতে রক্ত সংঘাতের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে কোমলমতি শিশু-কিশোর। আতংকে চোখে ঘুম নেই। পেটে ভাতও নেই। অজানা ভয় আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। বলছিলাম কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামের কথা। গ্রামটিতে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে গেল দুই বছরে চারটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন ৫০ জনের বেশি মানুষ। আধিপত্য বিস্তারে ধ্বংসের পথে পুরো গ্রামটি। আবারও ঘটতে পারে রক্তক্ষরণের ঘটনা। ভয়-আতঙ্কে অনেকেই গ্রাম ছেড়েছেন।
গ্রামের বাসিন্দা মুন্টু মন্ডল বলেন, এক সময়ে গ্রামের শেখ, মন্ডল ও ব্যাপারি নামে তিন সমাজে বিভক্ত ছিল পাহাড়পুরের মানুষ। সবাই মিলে মিশে বসবাস করতেন এখানেই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে বেঁড়েছে আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা। এখন শেখ ও মন্ডল মিলে এক সমাজ হয়েছে। আর তাদের প্রতিপক্ষ হয়েছে ব্যাপারি ও কটা মেম্বরের সমাজ। এখন গ্রামটি সামাজিক দলাদলিতে এক বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ যেন রক্ত সংঘাতের জনপদ। প্রতিদিনই ছোট বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এই গ্রামে।
গ্রামটির চিত্র দেখলেই মনে হবে কোনো একদিন বোমের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিলো পুরো গ্রাম। তবে আসলে তা নয়, এখানকার সমাজ প্রতিনিধিদের দলাদলির কারনে ২০১৭ সালে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে হত্যা করে প্রতিপক্ষ দলের মানুষ ও পরবর্তীতে উসকানীতে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ৩১ শে মার্চ প্রতিপক্ষের হামলায় একই পরিবারের ব্যাপারি সমাজের নেহেদ আলী ও বকুল আলী খুন হয়।
এ ঘটনায় উভয়পক্ষের অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ জন আহত হয়। এ ঘটনায় হামলা ও মামলার ভয়ে শেখ ও মন্ডল গ্রæপের প্রায় অর্ধশত পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে যান। সেই সুযোগে প্রতিপক্ষরা তাদের কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি গুলো ভেঙে মাটিতে গুড়িয়ে দেয়। কেটে নেই গাছপালা ও মাঠের ফসলও।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে লুটপাট ভাংচুরের ঘটনা। এতে প্রায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ঘটনার পরদিন নিহত নেহেদ আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে ১ এপ্রিল ২৮ জনকে আসামি করে কুমারখালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় গ্রেফতার ভয়ে আসামিরা প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার। সেই সুযোগে বাদীপক্ষ ও তৃতীয়পক্ষ মিলে এলাকায় চালায় ভাংচুর ও লুটপাট। কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি গুলো ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। কেটে ফেলা হয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-পালা। নষ্ট হয় মাঠের ফসলও। এভাবে চলতে থাকে প্রায় ১৮ মাস। ১৮ মাসে দলাদলিতে পাহাড়পুড় গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষের বাড়ি ঘর ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গ্রামবাসী বলছে, প্রায় ১৮ মাস পরে প্রশাসনের সহযোগীতায় গ্রাম ছাড়া অর্ধশতাধিক পরিবার ও আসামিরা জামিনে এলাকায় ফিরে। তবে এলাকায় ফেরার বিষয়ে বাদীপক্ষরা প্রতিপক্ষের সাথে সামাজিক বা প্রশাসনিক কোন সমাঝোতা বা বসাবসি ছিল না। ফলে জান ও মালের ঝুঁকি নিয়ে তারা পুনরায় বসতি গড়ে তোলে।
কেউ থাকেন কাগজের তাবু টাঙিয়ে, কেউ তৈরি করেছেন ছনখড়ের ঘর, কেউবা আবার তৈরি করেছেন টিনের জরাজীর্ণ ঘর। এভাবেই সময়ের সাথে সাথে পাহাড়পুড়ে বাড়ছিল জনসমাগম জনবসতিও। কিন্তু হঠাৎ খুনের বদলা নিতে গেল বছরের ৩১ শে ডিসেম্বর সকালে জোড়া খুন মামলার প্রধান আসামী ও নয়ন মন্ডলের ছেলে খোকন মন্ডলের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় বাদীপক্ষরা। শুরু হয় আবার রক্তপাত। এতে খোকন মন্ডলের বামহাতের কবজ্বির প্রায় ৯০ ভাগ কেটে গুরুতর আহত হয়। পরে স্বজনরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। বর্তমানে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
এরপর গেল (১৮ জানুয়ারি’২২) বিকেলে জোড়া খুনের বদলা নিতে সেই মামলার আরেক আসামী ও প্রতিপক্ষ সমাজ প্রধান আমিরুল ইসলাম কুপিয়ে হত্যা করে ব্যাপারি সমাজের লোকজন। এতে হামলা ও মামলার ভয়ে গ্রাম ছেড়েছেন ব্যাপারি সমাজের পুরুষেরা। হামলা ভাংচুর ও লুটপাটের ভয়ে ঘরের আসবাবপত্র ও গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে অন্য গ্রামের স্বজনদের বাড়িতে পালিয়ে যাচ্ছেন নারীরাও।
এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো, আকিব বলেন, ওই এলাকায় এখনও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। নতুন করে যাতে কোন সংঘাতের ঘটনা না ঘটে এতে আমরা সজাগ রয়েছি।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া-৪ কুমারখালী-খোকসা আসনের সাংসদ সেলিম আলতাফ জর্জ বলেন, এটা কোন রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি সামাজিক দ্বন্দ¦। এই বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা কাজ করছে। তারা দোষীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করবেন।
এদিকে গ্রামটিতে দুই বছরে চারটি খুনসহ আহত হওয়ার ঘটনায় আদালতে মামলা গুলো চলমান রয়েছে।