কোনো কিছুকেই বাধা মনে করছে না বিএনপি
অনলাইন ডেস্ক ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিলেটের গুরুত্ব অন্যরকম। দেশের প্রায় সবকটি বড় দলই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং নির্বাচনী প্রচারণা সিলেটের দুই সুফির মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে শুরু করে। রাজনৈতিক অঙ্গনে কথিত রয়েছে, সিলেট-১ আসনে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করে সে দলই সরকার গঠন করে। বহুল প্রচলিত এ কথাটি ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। সেই সিলেটে আগামীকাল শনিবার হতে যাচ্ছে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। সমাবেশের প্রচারণার সময় বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। ঘটেছে গ্রেপ্তারের ঘটনাও।
এমন প্রেক্ষাপটে সমাবেশ ঘিরে বিভাগজুড়ে পরিবহন ধর্মঘট ডাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তবে এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগে থেকেই অবলম্বন করা হয় সতর্কতা। কৌশল ও নির্দেশনা অনুযায়ী, ধর্মঘট শুরুর আগেই নেতাকর্মীরা সিলেটে আসতে শুরু করেছেন। কোনো ধরনের উসকানিতে পা না দিয়ে সমাবেশ সফল করার দিকে এখন নজর দলের নেতাদের।
সিলেটের গণসমাবেশের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে চাইলে সমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির দলনেতা ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকারের ইন্ধনে সিলেট বিভাগজুড়ে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। সমাবেশের প্রচারের সময় বিভিন্ন জায়গায় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে ছাত্রলীগ মিছিল সহকারে সমাবেশের মাঠের পাশ দিয়ে কয়েকবার মহড়া দিয়েছে। এটি করা হয়েছে মূলত মাঠে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য। কিন্তু আমরা কোনো উসকানিতে পা দিচ্ছি না। একই সঙ্গে কোনো প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ মনে করছি না। যত বাধা দেবে নেতাকর্মী ও মানুষের ভেতরে সমাবেশ সফল করার আকাঙ্ক্ষা ততই বাড়বে।
বিএনপির এ যুগ্ম মহাসচিব আরও বলেন, হাওর অধ্যুষিত হওয়ায় হবিগঞ্জ-সুনামগঞ্জ থেকে নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছেন নদীপথে। যদিও সমাবেশের এখনো দুই দিন বাকি। তবে এরই মধ্যে মাঠ ভরে গেছে। নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে তাঁবু টাঙিয়ে থাকছেন। সেখানেই চলছে রান্নাবান্না। সমাবেশের দিন সকালে যারা আসবেন, মনে হয় না তারা মাঠে জায়গা পাবেন। তাদের হয়তো মাঠের পাশের রাস্তায় বা অন্য জায়গায় অবস্থান নিতে হবে।
জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও দলের নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। এ পর্যন্ত ছয়টি বিভাগীয় সমাবেশ হয়েছে। গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে প্রথম সমাবেশ হয়। এরপর ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল এবং সর্বশেষ ফরিদপুরে (সাংগঠনিক বিভাগ) সমাবেশ হয়। চট্টগ্রাম ছাড়া বাকি সমাবেশগুলোর আগেই পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।
বিএনপি বলেছে, সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে সরকারের ইন্ধনে এসব ধর্মঘট ডাকা হয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে দলটির বেশিরভাগ নেতাকর্মী ধর্মঘট শুরুর আগেই সমাবেশস্থলে আসেন। বাকি নেতাকর্মীরা সমাবেশে আসেন বিকল্প উপায়ে। কেউ কেউ সমাবেশে এসেছেন মাইলের পর মাইল হেঁটে। সিলেটেও পরিস্থিতি একই। এরই মধ্যে ডাকা হয়েছে পরিবহন ধর্মঘট। প্রথমে সমাবেশের দিন শুধু সিলেটে বাস ধর্মঘট ডাকা হলেও এবার বিভাগজুড়ে সব ধরনের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। এর আগে সিলেট, মৌলভীবাজার জেলাসহ সুনামগঞ্জ-সিলেট রুটে ১৮ ও ১৯ নভেম্বর সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ধর্মঘট প্রসঙ্গে বাস মালিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশে সিলেটে কোনো ধর্মঘট ডাকা হয়নি। আঞ্চলিক মালিক সমিতি তাদের দীর্ঘদিনের দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।’ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘সিলেটের এই ধর্মঘটের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। সিলেটের শ্রমিক নেতারা এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। নিজেদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত ইস্যুতে হয়তো এই ধর্মঘট ডাকতে পারে।’
তবে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, সরকারের ইন্ধনে সিলেটের গণসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতেই এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে সমাবেশে কোনো প্রভাব পড়বে না। শনিবারের আগেই নেতাকর্মীরা সিলেটে পৌঁছে যাবেন। শহরে তাদের থাকারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির জানান, সারাদেশের মতো সিলেটেও ধর্মঘট ডাকা হলো। এই সরকার জনগণের সরকার নয়। তারা যখন খবর পায় কোথাও সমাবেশ হচ্ছে, তখন নানাভাবে তা প্রতিহত করে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ নানাভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের হয়রানি করছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, বিএনপির সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার ও হামলা অব্যাহত রয়েছে। তবে এসব করে সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। সব বাধা পেরিয়ে অন্য বিভাগীয় গণসমাবেশের মতো সিলেটেও জনতার ঢল নামবে।
সিলেট বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, সিলেট জেলা ও মহানগর ছাড়াও বিভাগের অধীন সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের নেতাকর্মীরা সমাবেশে আসবেন। এর বাইরে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ জেলার নেতাকর্মীরা সিলেটের গণসমাবেশে অংশ নেবেন। সিলেট এলাকা মূলত হাওর অধ্যুষিত হওয়ায় বেশিরভাগ নেতাকর্মী আসবেন নদীপথে।
জানা যায়, আগের সমাবেশগুলোর অভিজ্ঞতায় সিলেটেও পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হতে পারে—এমনটি ধরে নিয়েই পূর্বের কৌশল অনুযায়ী দলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন জেলা থেকে আগেভাগেই শহরে আসতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে হাজার হাজার নেতাকর্মী সিলেটে এসে পৌঁছেছেন। তাদের রাতে মাঠে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত বুধবারও অনেক নেতাকর্মী মাঠে অবস্থান নেন।
সিলেট ব্যুরো জানিয়েছে, ধরপাকড় ও হয়রানি এড়াতে বিএনপি নেতাকর্মীরা হোটেল-মোটেলে উঠছেন না। বিকল্প হিসেবে তারা সমাবেশস্থল নগরের চৌহাট্টা এলাকার সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ক্যাম্প ও নগরীর বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে থাকছেন।
গতকাল বিকেলে সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গণসমাবেশের মঞ্চ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলছে মাঠ প্রস্তুতির কাজ। বিকেলে সমাবেশস্থল পরির্দশনে আসেন গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। এ সময় তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন, আরিফুল হক চৌধুরীসহ স্থানীয় নেতারা ছিলেন।
এদিকে সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুদলই নিজেদের শক্তি দেখাতে শোডাউন দিচ্ছে। গতকাল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে সমাবেশস্থলের পাশে শোডাউন করে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নীরব থাকার পর এই সমাবেশকে ঘিরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের মোটরসাইকেল শোডাউন
গতকাল বিকেলে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে সমাবেশস্থলের পাশেই চৌহাট্টা-জিন্দাবাজারে মিছিল করেছে। এ সময় বিএনপির সমাবেশস্থলে সাধারণ কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা তাদের সরিয়ে নেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ছাত্রলীগ চৌহাট্টা ও জিন্দাবাজারে অবস্থান নেয়। পরে তারা সেখান থেকে সরে যান। এর আগে সিলেট জেলা ছাত্রলীগ নগরের টিলাগড় পয়েন্ট ও মহানগর ছাত্রলীগ রিকাবীবাজার পয়েটে সমবেত হয়ে চৌহাট্টা পয়েন্টে এসে জড়ো হয়।
সিলেটে রাজনৈতিক সম্প্রীতির বন্ধন আওয়ামী লীগ নষ্ট করতে শুরু করেছে অভিযোগ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটে রাজনীতির একটি সুন্দর ধারা ও সম্প্রীতি আছে। এখানে আমাদের বিএনপির অনেক নেতা জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা সব সময়ই সুন্দর ও পরিপাটি রাজনীতি করতে পছন্দ করি; কিন্তু সিলেটে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। পুলিশ-ছাত্রলীগকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে; কিন্তু এখন আর মানুষকে ঘরে রাখা সম্ভব না। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। এই সরকারের পতন নিশ্চিত করেই তারা ঘরে ফিরবে।’
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, সিলেটের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে সম্প্রীতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। এখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সবাই একে অপরের সঙ্গে সবসময়ই সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করে থাকেন। এবারও সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। সিলেটে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়।