ভোরবেলা হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, রান্না আর সংসারের নিত্যকাজ সামলে যখন গ্রামীণ নারীরা একটু অবসর নেন, তখনই তাদের হাত ভিজে ওঠে কাদামাটিতে। ধীরে ধীরে সেই মাটির ছোঁয়ায় জন্ম নেয় দেবীমূর্তির কাঠামো। খড়ের গায়ে মাটি মেখে আকার দেন, রোদে শুকিয়ে তোলেন, আবার কখনো তুলির আঁচড়ে দেন রঙ। সংসারের চেনা পরিসরে এবার নতুন দৃশ্য, নারীর কোমল হাতেই তৈরি হচ্ছে দুর্গা প্রতিমা।
কুড়িগ্রামের বিভিন্ন কুমোরপাড়া ও পালপাড়ার প্রতিমা কারখানাগুলোয় এমন ব্যস্ততা এবারই প্রথম চোখে পড়ছে। বছরের পর বছর ধরে পুরুষরাই এই শিল্পের প্রধান কারিগর ছিলেন। কিন্তু এবার চাপ বেড়েছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। জেলায় প্রতিমার চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে ঘরের নারী সদস্যরা সংসারের কাজের পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছেন প্রতিমা কারিগরের কাতারে। তাদের হাতে চলছে প্রতিমার কাঠামো গড়া থেকে শুরু করে রঙ, অলংকার, শাড়ির কাজ সবই।
এ দৃশ্য শুধু নতুন নয়, এক অর্থে সাহসীও বটে। পারিবারিক পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা আর সহজাত নেশার টানে নারীরা এগিয়ে এসেছেন পুরুষদের পাশে দাঁড়াতে। রাজারহাট উপজেলার বৈদ্যের বাজার গ্রামের বেবী মালাকর জানালেন, “এবার জেলায় গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ পূজা হচ্ছে। মণ্ডপগুলো রেডিমেড প্রতিমার অর্ডারও দিয়েছে। আগে সংসারের কাজ সামলে প্রতিমার কাজে হাত দেওয়া হয়নি। কিন্তু এ বছর এত চাপ, বাধ্য হয়ে সংসারের কাজ ফেলে স্বামীকে সাহায্য করছি।”
শুধু গৃহবধূ নয়, কিশোরী মেয়েরাও শিখে নিচ্ছে প্রতিমা গড়ার কাজ। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সপ্তমী মালাকর বলেন, “এক সপ্তাহ ধরে স্কুলে যাই না। বাবা একা এত কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। গতবার আমরা সাতটা প্রতিমা বানালেও এবার অর্ডার এসেছে পনেরোটা। তাই আমিও মাটি গড়তে, কাঠামো বাঁধতে শিখছি। বাবাকে সাহায্য করছি।” সংসারের প্রয়োজন আর পারিবারিক দায়বদ্ধতা যেন ছোট্ট মেয়েদেরও টেনে এনেছে শিল্পের জগতে।
সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি বাজারের পূজা রানী আগে প্রতিমার অলংকার বা সাজসজ্জার কাজের সঙ্গে খুব একটা যুক্ত ছিলেন না। তিনি জানালেন, “প্রথমবারের মতো মায়ের প্রতিমা তৈরি করছি। আগে শুধু প্রদীপ, ধূপকাঠি বা কলস বানাতাম। কিন্তু এবার প্রতিমার অলংকার, মুকুট, গায়ের রঙ দেওয়ার কাজ করছি। ভিন্ন ধরনের আনন্দ লাগছে নিজের হাতে দেবীমূর্তি সাজাতে।” নারীর কোমলতা যেন প্রতিমার সাজে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অন্যদিকে বংশ পরম্পরায় প্রতিমা শিল্পী কালিকান্ত পাল বললেন, “সারা বছর আমরা মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে সংসার চালাই। দুর্গাপূজার সময়ই আসে বড় অর্ডার, তখনই একটু স্বস্তি মেলে। গতবার আটটা প্রতিমা বানিয়েছি, এবার অর্ডার এসেছে চৌদ্দটার। একা হাতে সম্ভব নয়, তাই ঘরের মেয়ে-বউরা কাজে লেগে পড়েছে। তাদের সাহায্য না পেলে এত কাজ শেষ করা যেত না।” পারিবারিক সহযোগিতা যেন শিল্পের টিকে থাকার অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে।
কুড়িগ্রাম পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য বলছে, জেলার ৯টি উপজেলায় এ বছর মোট ৫১৭টি পূজা মণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫৫টি, রাজারহাটে ১৩১টি, উলিপুরে ১২৫টি, চিলমারীতে ২৪টি, নাগেশ্বরীতে ৬৯টি, ভূরুঙ্গামারীতে ২০টি, রৌমারীতে ৭টি, রাজিবপুরে ১টি, ফুলবাড়ীতে ৬৫টি এবং কুড়িগ্রাম পৌরসভায় ২০টি। যা গত বছরের তুলনায় ৩২টি বেশি। পূজার সংখ্যা বাড়ায় প্রতিমার চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। এই চাপই নারীদের প্রথমবারের মতো প্রতিমা তৈরির কাজে যুক্ত করেছে।
এখন মহালয়া শেষ, চারপাশে পুজোর আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। মণ্ডপে ঢাকের বাদ্য নামার আগেই নারী হাতের মমতায় প্রতিমা সাজতে শুরু করেছে নতুন রূপে। সংসার সামলে যারা প্রতিদিন লড়াই করেন, সেই নারীরাই আজ হয়ে উঠেছেন শিল্পী। তাদের মাটিতে মাখা হাতেই জন্ম নিচ্ছে দেবীর নতুন মহাকাব্য। যেখানে প্রতিটি প্রতিমার ভাঁজে ভাঁজে লেখা আছে শ্রম, ভালোবাসা আর টিকে থাকার গল্প।
jn