ঐতিহ্যে লালিত স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো কুমিল্লা টাউন হল (বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন)। ৩ একর ৪৩ শতক জায়গা নিয়ে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মিলনায়তনটি পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা টাউন হল হিসেবে গড়ে ওঠে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের স্মৃতি বহন করা টাউন হলটি কুমিল্লাবাসীর গৌরব ও প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক। মাঠের ধুলোবালু, টাউন হলের বিবর্ণ দেয়াল আর সিঁড়ি সবই যেন আপন মনে হচ্ছে। এসবই যেন টাউন হলের নিজস্বতা। চাকচিক্য, ধোপদুরস্ত চেহারা কি টাউন হলকে মানায়? তাই তো ধুলো, দাগ, পড়ে থাকা সিগারেটের ফিল্টার, এমনকি সিঁড়িতে ভিক্ষা চাওয়া কিশোরীটিকেও আপন লাগে। ঝাঁ–চকচকে প্রিমিয়াম শপগুলোতে এ রকম আপন আপন ব্যাপারগুলো কোথায়? বিভিন্ন সময় কুমিল্লা টাউন হলে উপমহাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বক্তৃতা করেন। মহাত্মা গান্ধী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পঁচাত্তরের পরের বাংলাদেশের সরকারপ্রধানেরা এখানে বক্তব্য দেন। কুমিল্লার আন্দোলন–সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু এই টাউন হল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সূর্য ঠিক মাথার ওপর। ভেতরে আলো-আঁধারির খেলা। কোথাও শেষ বিকেলের আলো উঁকি দিচ্ছে তো কোথাও জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। ভেতরে ঢুকতেই কানে এল অসংখ্য মানুষের একসঙ্গে কথা বলার আওয়াজ—চায়ের কাপে ধোঁয়া তোলা একদল উচ্ছল তরুণ-তরুণী আড্ডা দিচ্ছে মাঠের ভেতর। এক জায়গায় এসে কিচিরমিচির করছে। যে যার সঙ্গে রয়েছে, সে ছাড়া কেউ কারও কথা বুঝতে পারারই কথা নয়। রাত অবধি সেই আড্ডা টেনে যায়। ফিসফিসিয়ে কথা বলার বালাই নেই। সবাই গলা উঁচু করে যার যার মতো করে কথা বলে চলছে। ফাঁকে চলছে ভাজাভাজি মুখে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া। ধূমপানেও সেখানে বাধা নেই। তাই দেদার চলছে ধূমপানও। টাউন হলের ১৩টি টংয়ের চা দোকান রয়েছে। এখানে সব রকমের চা পাওয়া যায়। মালটার চা, গরুর দুধের চা, হরলিক্সের চা, মালটোবার চা, স্পেশাল দুধ মালাইয়ের চা, তেঁতুলের চা, মসলার চাসহ হরেক রকমের চা পাওয়া যায়। তবে এখানে বেশির ভাগ মানুষের পছন্দের গরুর দুধের চা।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুমিল্লার ‘কাগজ প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত হয় তরুণ ইতিহাসবিদ ও কুমিল্লা টাউন হলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসানুল কবীরের লেখা ‘কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থ। এতে উল্লেখ করা হয়, ১৮৮৫ সালের ৬ মে নগরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের ৩ একর ৪৩ শতক জায়গা নিয়ে কুমিল্লা টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয়। হলের প্রতিষ্ঠাতা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর। দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে ভবনটি নির্মিত। ১৯৩০ সালে এটি প্রথম সংস্কার করা হয়। ২০০২-০৩ সালে এটি পুনরায় সংস্কার করা হয়। কিশোর থেকে তরুণ-তরুণী, এমনকি প্রবীণরাও এসে সামিল হন টাউন হল মাঠে। শুধু নগরের মানুষ নয়, দলবেঁধে গোমতী নদীর ওপার শাহপুর, মাঝিগাছা এবং পালপাড়া থেকে চা খেতে ছুটে আসে তরুণ-তরুণীরা। চা দোকানদার সোলায়মান মিয়া বলেন, সকাল ৫টার দিকে ঘুম থেকে উঠি। উঠে যেসব খামারিদের সাথে চুক্তি আছে তারা প্রতিদিন ড্রামে করে গরুর দুধ দিয়ে যায়। কখনো তারা দিয়ে যেতে না পারলে আমরা নিজে যেয়ে আনি। গরুর দুধের সাথে বাজারের উন্নতমানের পেকেটের পাওডার দুধ দিয়েও চা বানাই। আগের গরুর দুধের চা ১০ টাকা বিক্রি করতাম এখন চিনি,দুধ ও এলপি গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে প্রতিকাপ চা ১৫ টাকা বিক্রি করি। মাল্টার চা ১০ টাকা,মালটোবার চা ২০ টাকা, দুধ মালাইয়ের চা ২০ টাকা, তেতুলের চা ২০ টাকা, মসলার চা ২৫ টাকা, হরলিক্সের চা ২৫ টাকা।
তিনি আরও জানান, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কাপ চা বিক্রি হয়। কখনো কখনো আবার এর কম-বেশি হয়। চা দোকানদার সবুজ, আমান, মহিন, জামাল জানায়, চা খেতে টাউনহল মাঠে অনেক জায়গা থেকে হরেক রকমের লোক আসে চা খায় আড্ডা মারে আবার চা খায় আবার চলে আড্ডা। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী সুমাইয়া, পুতুল আক্তার এবং নিশাতের সাথে। তারা জানান, আমরা বন্ধুরা মিলে এখানে চা খেতে আসি আড্ডা দেই। কখনো কখনো কথা বলতে বলতে ২ থেকে ৩ কাপ চা পর্যন্ত চা খাই। গরুর দুধের চা আমরা বেশি পছন্দ করি। কথা হয় সদর দক্ষিণ থেকে আসা সোনার বাংলা কলেজের শিক্ষার্থী ফাহিম ও আরিফের সাথে।তারা জানান আমরা ফ্রেন্ডসরা বাইক দিয়ে সন্ধ্যার পর চা খাওয়ার জন্য কুমিল্লা টাউনহলের টং দোকানে গু আসি। চা খাই আড্ডা দেই আবার চা আবার আড্ডা এভাবে দুই আড়াই ঘন্টা চলে যায়। একটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি সুমন ইসলাম জানান, অফিস শেষ করে আমরা কলিগরা এখানে এসে চা খাই। এখানের টং দোকানের গরুর দুধের চা আমাদের বেশি খাওয়া হয়। কুমিল্লা কান্দিরপাড় পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মাইনুল বলেন, আমরা টাউনহলে চা খেতে আসা বিভিন্ন বয়সের লোকজনকে নজরদারিতে রাখি। তার মূলত চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে চলে যায়।
শান্ত/অননিউজ