ট্যারিফ কমিশনের অনুমতি পেয়ে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন খোলা চিনির সর্বোচ্চ দর ১০২ টাকা আর প্যাকেটজাত হলে ১০৮ টাকা দর বেঁধে দেয়। তবে বাজারে চিনির সরবরাহ একেবারেই কম। আর দাম রাখা হচ্ছে ১১৫ থেকে ১৩০ টাকা।
ইস্কাটনের মীনা বাজার। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন বা বিএসএফআইসি উৎপাদিত চিনি নির্ধারিত দর ৯৯ টাকাতেই পাওয়া যাচ্ছে।
একজন ক্রেতা তিন কেজি নিতে চাইলেই মীনা বাজারের এক কর্মী ছুটে এলেন। বললেন, ‘স্যার, সর্বোচ্চ দুই কেজি নিতে পারবেন।’
-কেন?
-‘আসলে চিনির এখন সংকট। বেশি মানুষকে যেন দেয়া যায়, তাই আমরা দুই কেজির বেশি দিচ্ছি না একেকজনকে।’
সরকারের বেঁধে দেয়া এই দরে এই চিনি এখানে মিললেও সড়কের অপরপাশে আরেক সুপার শপ স্বপ্নতে খোলা চিনি চিক্রি হচ্ছিল নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে। সেখানে প্রতি কেজির দাম রাখা হচ্ছিল ১১৫ টাকা, যা তিন দিন আগেও ছিল ১১২ টাকা।
বৃহস্পতিবার কেজিতে ১৩ টাকা বাড়িয়ে বেসরকারি চিনির সর্বোচ্চ যে খুচরা মূল্য ঠিক করে দেয়া হয়েছে, তা থেকেও ১৩ টাকা বেশি রাখছে প্রতিষ্ঠানটি।
ট্যারিফ কমিশনের অনুমতি পেয়ে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন খোলা চিনির সর্বোচ্চ দর ১০২ টাকা আর প্যাকেটজাত হলে ১০৮ টাকা দর বেঁধে দেয় বৃহস্পতিবার।
এর আগে দর ছিল যথাক্রমে ৯০ ও ৯৫ টাকা। কিন্তু বাজারে এই দরে চিনি পাওয়াই যাচ্ছিল না। ১৩ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সেই একই চিত্র।
কারওয়ানবাজারে দোকানগুলোতে গিয়ে পর্যাপ্ত চিনিও পাওয়া যায়নি। কারও কারও দোকানে একদম নেই, এক দুটিতে পাওয়া গেলেও নির্ধারিত দরের বেশি রাখছে সবাই।
খোলা চিনি ১১৫ টাকা আর প্যাকেজটাত চিনির দাম ১৩০ টাকাও চাইতে দেখা গেছে।
তেলের ক্ষেত্রে অবশ্য চিত্রটা এমন নয়। তবে এর আগে লিটারে দাম কমানোর ঘোষণার পর নতুন দরের তেল বাজারে আসতে যে বিলম্ব দেখা গিয়েছিল, সেটি এবার ঘটেনি। নতুন দামের বোতল ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। যদিও দাম কমানোর ঘোষণার পর বিক্রেতারা দাবি করেছিলেন, নতুন তেল আসতে দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
সয়াবিন তেলের লিটার এখন ১৯০ করে আর ৫ লিটারেরটি ৯২৫ টাকা।
লিটারপ্রতি খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৭২ এবং পাম তেলের দাম ১২১ টাকা করা হয়েছে।
‘সঠিক চিনি পাই না, তাই বেচি না’
তারিক আজিজ খান চিনি কিনতে গিয়ে ঘুরেছেন হন্যে হয়ে। শেষমেশ পেলেও ভোগান্তির কারণে ক্ষুব্ধ।তিনি বলেন, ‘বিষয়টা বোঝেন, ১৩ টাকা বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দাম। ঘুরে দেখেন, তাও প্রত্যেক দোকানে পাবেন না।’
বাজারের মাসুদ জেনারেল স্টোরের স্বত্ত্বাধিকারী মো. মাসুদ দাবি করেন, খুচরা সর্বোচ্চ যে দর বেঁধে দেয়া হয়েছে, সে দরে তারাই পান না।
তিনি বলেন, ‘প্যাকেটজাত চিনি তো নাই। খোলা চিনির ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সাড়ে ৫ হাজার টাকা নেয়। তাহলে কেনা দাম পড়ে ১১০ টাকা, এর সঙ্গে যদি লেবার খরচ ধরি, আর এক কেজি করে মেপে বিক্রি করতে গিয়ে যে ঘাটতি তা হিসাব করা হলে কয় টাকা পড়ে? এর পরেও যারা নিচ্ছেন তারা ১১২ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি করছেন। আবার এই দামে বিক্রি করলেও সমস্যা। তাই বেচা বাদ দিয়েছি।’
কাঞ্চনপুর হাজি স্টোরের মিজানুর রহমান বলেন, ‘বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, অনেক সময় রশিদও দেয় না। ভোক্তা অধিদপ্তর বা অন্য কোনো সরকারি অভিযান পরিচালনা করলে জরিমানা গুণতে হবে আমাদের। তাই চিনি বেচা বন্ধ করে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘নতুন দামের প্যাকেট আসলে এবং মাল পেলে বিক্রি করব।’
শাহ্ মিরান জেনারেল স্টোরের লক্ষণ চক্রবর্তী বলেন, ‘১০৮ থেকে ১০৯ টাকা কেনাই পড়ে। এর থেকে দুই-এক টাকা বেশিতে বিক্রি করি আমরা। কাল থেকে যদি নতুন দামে আসে এবং আমরা পাই, তাহলে সেই দামেই বিক্রি করব। না পেলে করব না।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চান না ডিলাররা। তারা দায় চাপিয়েছেন কোম্পানিগুলোর কাঁধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডিলার বলেন, ‘আমরা তো আর লস দিয়ে ব্যবসা করতে পারব না, যেমন দামে কিনব এবং সরবরাহ পাব, সেই অনুপাতেই বিক্রি করব।’
অভিযোগ স্বীকার করে না চিনি কোম্পানি
চিনির সরবরাহ ও বেশি দাম রাখার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা যে অভিযোগ করছেন, তা স্বীকার করতে চাননি চিনি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ঢাকা মেট্রো ডিভিশনের সিনিয়র ম্যানেজার অমল সাহা। তিনি বলেন, ‘গতকালও গাড়ি ভিড়িয়ে কারওয়ান বাজারে ৯৫ টাকা দরে চিনি বিক্রি করেছি।’
উৎপাদনে ঘাটতি আছে, এই বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। বলেন, ‘পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় উৎপাদনে কমে গেছে। চিনি পরিশোধনের জন্য যেসব মেশিন ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতে প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এক ঘণ্টা তো লাগে মেশিন গরম হতেই, অথচ দেখা যায় এক ঘণ্টা পরেই পাওয়ার নাই। উৎপাদন বন্ধ হলে চিনি আসবে কোত্থেকে?’
দাম বাড়তেই এসে গেল নতুন দামের তেল
গত ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে ভোজ্যতেল কোম্পানির মালিকদের বৈঠক শেষে এক বিজ্ঞপ্তিতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে কমানো হয় ১৪ টাকা। জানানো হয়, পরদিন থেকেই কার্যকর হবে এই দাম।
কিন্তু পরের দিন তো দূরের কথা পরের এক সপ্তাহেও কম দামের তেল পায়নি দেশবাসী। ব্যবসায়ীরা দাবি করতে থাকে, তাদের বেশি দামে কেনা তেল তাই দাম বেশি রাখতে হচ্ছে। কোম্পানিগুলো দাবি করতে থাকে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে নতুন দামের তেল আসতে।
তবে আসলে যে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে না, সেটি প্রমাণ হলো এবার।
বৃহস্পতিবার দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর রাতেই বাজারে আসে বাড়তি দরের তেল।
কারওয়ানবাজারে ৫ লিটারের সয়াবিনের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯২৫ টাকায়। কেউ কেউ ৫ টাকা কমও রাখছেন।
শাহ্ মিরান জেনারেল স্টোরের মামুন হোসেন বলেন, ‘রাতেই গাড়ি এসেছে, নতুন দামে ৫ লিটারের বোতল সাপ্লাই দিয়েছে। ১ লিটার বা অন্যান্য বোতল এখনও আসেনি। আগের বোতল আগের দামেই দিচ্ছি, নতুন বোতল নিলে ৯২০ টাকা রাখছি।’
নতুন তেল সরবরাহের কথা জানা কারওয়ান বাজারের ডিলার ইয়াসিন এন্টারপ্রাইজের বিপ্লব চন্দ্র পাল।