পেশী শক্তি আর নানা কলাকৌশলে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার চেষ্টা থাকে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বলীদের। যে বা যারা এই দুটো বিষয়কে আয়ত্ত করতে পারেন, তারা সক্ষম হন ফাইনাল রাউন্ডের রিংয়ে আসতে। মাথায় মাথা ঠেকিয়ে ঝুঁকে কুস্তি প্রতিদ্বন্দ্বীদের একে অন্যের নিশ্বাসের গতিবিধি দেখে কুপোকাত করার চেষ্টা তো আছেই। ঢাক-ঢোলের মহারণ বাদ্যে ঐতিহ্যবাহীর লালদীঘি ময়দানে এমন চিত্র ফের তিন বছর পর দেখতে পেল নগরবাসী।
বাহুবলে বলীয়ানরাও পেলেন লালদীঘির মাঠে ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলী খেলার আবেশ। এ জন্য উচ্ছ্বসিত সকলে। আর বাঁশির সুরের সঙ্গে জয়ঢাকের তালে কুস্তিগিররা নাচলেও কৌশল ও বাহুবলে শেষ হাসিটা হেসেছেন কুমিল্লার শাহ্জালাল, যিনি গতবারের রানার্সআপ।
আব্দুল জব্বারের বলী খেলার ১১৪তম আসরের চ্যাম্পিয়নের শিরোপা পেয়ে উচ্ছ্বসিত শাহ্জালাল বারবার মঞ্চে লাফিয়ে তার জয় উদ্যাপন করছিলেন। তিনি বলেন, প্রতিবার আসি। গতবারের মধুর প্রতিশোধ নিলাম এবার। এর আগে ১১০তম আসরে কুমিল্লার শাহ্জালাল জয়ী হয়েছিলেন। লালদীঘি মাঠে বলী খেলা ফিরেছে তিন বছর পর। করোনায় দুই বছর খেলা ও মেলা হয়নি।
এরপর গত বছর মাঠটির সংস্কার কাজের জন্য সেখানে বলী খেলা করা যায়নি। ইতিহাস সংস্কৃতির ধারক-বাহক চট্টগ্রাম বিপ্লবতীর্থ হিসেবে পরিচিত। দেশের সব আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রভাগে থাকা চট্টগ্রাম বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিক। গর্ব ও অহংকার করার মতো সংস্কৃতি কৃষ্টি রয়েছে এখানে। যার ফলে ঈদের পর বৈশাখের তীব্র দাবদাহের মধ্যেও বলী খেলায় উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। লালদীঘির ময়দানে স্থাপিত বলী খেলার রিংয়ে যখন প্রতিদ্বন্দ্বী বলীরা একে অন্যকে কুপোকাত করছিলেন তখন চারদিকে জয়োল্লাসের ধ্বনি।
তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে কোনো ধরনের ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই হাজার হাজার দর্শনার্থীর চোখ ছিল লালদীঘির মাঠের অস্থায়ীভাবে নির্মিত বালুর মঞ্চের দিকে। বরাবরের মতো প্রধান রেফারি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মালেক, যদিও এবার তিনি অবসরে যাচ্ছেন। প্রধান রেফারির দায়িত্ব পালন করলেও তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী রেফারি বলী খেলার ৫ বারের চ্যাম্পিয়ন ছিদ্দিক আহমেদ বলীসহ আরও দুজন।
মঞ্চে প্রথম রাউন্ডের খেলা শুরু যখন হয় তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৩টা ৫০ মিনিট। বাঁশি ও ঢোলের শব্দে লালদীঘি যেন একখ- স্টেডিয়াম। এবারের বলী খেলায় ১শ’ জন রেজিস্ট্রেশন করলেও বাছাই করা হয় ৬০ জনকে। আর গতবার অংশ নিয়েছিলেন মোট ৭২ জন।
মঙ্গলবার বিকেলে বলী খেলার প্রথম রাউন্ড শুরু হলেও ৪টা ১৭ মিনিটে দু’জন বলী লড়তে লড়তে রিংয়ের বাইরে মাঠে পড়ে যান। তারা প্রায় ১৭ মিনিট যাবত একে অন্যকে কুপোকাত করার চেষ্টা করে। প্রথম রাউন্ডে লড়তে আসা অধিকাংশই মহেশখালীর বাসিন্দা। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত তারা কেউ আসতে পারেনি। বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে শেষ হয় প্রথম রাউন্ড। এরপর বিচারকরা প্রথম রাউন্ড থেকে ৫ জনকে নির্বাচিত করেন। তারা হলেন রুবেল, সেলিম, মুসা, আমির হোসেন এবং আব্দুন নূর।
অপরদিকে ২০২২ সালের চ্যাম্পিয়ন তরিকুল ইসলাম জীবন, রানার আপ শাহ্জালাল এবং তৃতীয় স্থান অধিকারী সৃজন চাকমাও দ্বিতীয় রাউন্ডে অংশ নেন। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শুরু হয় ৪টা ৫৮ মিনিটে। সেখান থেকে সেমিফাইনালে ওঠেন ৪ জন। তারা হলেন আনোয়ারার আবদুর নূর, কুমিল্লার শাহ্জালাল, খাগড়াছড়ির সৃজন চাকমা ও চকরিয়ার জীবন বলী। সেমিফাইনালে অংশ নেওয়া প্রতিযোগীরা লটারির মাধ্যমেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন করেন। সেমিফাইনালে জীবন বলীর সঙ্গে লড়েন সৃজন চাকমা। আর শাহ্জালাল বলীর সঙ্গে লড়েন আব্দুর নূর। সেমিফাইনালে সৃজন ও জীবন বলীর কুস্তি চলে প্রায় ১২ মিনিট। দীর্ঘ সময় লড়াই করে সৃজনকে হারিয়ে প্রথমে ফাইনাল রাউন্ড নিশ্চিত করেন জীবন। অপরদিকে ২ মিনিটের মধ্যে আব্দুর নূরকে পরাস্ত করে শাহ্জালাল ফাইনাল নিশ্চিত করেন। এদিকে তৃতীয় স্থান নির্ধারণীতে আব্দুর নূরকে হারিয়ে যথারীতি সৃজন চাকমা দ্বিতীয়বারের মতো তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
যথারীতি চূড়ান্ত পর্বে শাহ্জালালের সঙ্গে জীবনের দেখা এ পর্যন্ত তিনবার। গতবার ছাড়াও এর আগে ১১০তম আসরে তারা দুজন লড়েন ফাইনালে। মঙ্গলবার ফাইনাল রাউন্ডে তারা লড়েন প্রায় ২ মিনিট। মিষ্টি প্রতিশোধে জীবনকে কুপোকাত করে চ্যাম্পিয়ন হন কুমিল্লার শাহ্জালাল। এর আগে ১০৯তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন জীবন বলী। ১১০তম আসরে কুমিল্লার শাহ্জালাল জয়ী হলেও ১০৯তম আসরে কক্সবাজারের চকরিয়ার বাসিন্দা জীবনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। তখন খেলায় অবৈধ কৌশল অবলম্বন করার অপরাধে রেফারি শাহ্জালালকে খেলার অযোগ্য করে জীবনকে জয়ী ঘোষণা করেছিলেন।
চট্টগ্রামের এই বলী খেলা বিখ্যাত ও ইতিহাসখ্যাত। বিশেষ করে বাংলাদেশে জব্বারের বলী খেলার নাম সব জেলার মানুষের কাছে বেশ পরিচিত। কেউ বলী খেলাকে পছন্দ করেন বলে পরিচিত আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা চেনে তিন দিনব্যাপী মেলার বিকিকিনির ব্যাপকতার জন্য। তাই জব্বারের বলী খেলা ও মেলার বিষয়টি জানেন না এবং শোনেনি এমন লোক পাওয়া কঠিন বিষয়। একুশে পদক (মরণোত্তর) পাওয়া ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরী ‘বন্দর শহর’ বইটিতে চট্টগ্রামের ২২ মল্ল পরিবার যে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এবং ঐতিহাসিক তাতে এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। তাই বলী খেলায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বলীরা আসেন। চট্টগ্রামসহ আশপাশের জেলা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক বলী আসেন এই ঐতিহাসিক খেলায় অংশ নিতে।
সেই শত বছর আগে বাংলা পঞ্জিকার ১৯০৯ সানের ১২ বৈশাখ, যার সূচনা করেন চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বদরপাতি এলাকার আবদুল জব্বার সওদাগর। ব্রিটিশবিরোধী আন্দেলনে দেশের তরুণ ও যুব সমাজকে সংগঠিত করতে মূলত লালদীঘির মাঠেই এই কুস্তি/বলী খেলার প্রবর্তন করেন তিনি। পরে তা জব্বারের বলী খেলা নামেই পরিচিতি পায়।
মঙ্গলবার বিকেল তিনটার পরে বলী খেলার উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তারা চ্যাম্পিয়ন শাহ্জালালের হাতে শিরোপাসহ নগদ ২৫ হাজার টাকা ও রানার্সআপ জীবনকে শিরোপাসহ ২০ হাজার টাকা তুলে দেন।
এদিকে এর আগে বলী খেলায় অংশ নিতে দুপুর ১২টা থেকে বিভিন্ন জেলার বলীরা মেলা কমিটির কার্যালয়ে তাদের নাম এন্ট্রি করেন। বিকেলে ঘোষণা মঞ্চ থেকে বলা হয় ৬০ জন অংশ নিয়েছেন। তবে প্রাথমিক রাউন্ডগুলোতে সকলের উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও আগ্রহ ছিল ফাইনাল রাউন্ডের দিকে। দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে পরিচিত এই জব্বারের বলী খেলা ও মেলাটির বড় আকর্ষণ বলী খেলা। তাই দূর-দূরান্ত থেকে পরিবার পরিজন নিয়েও অনেকে এসেছেন।
এদিকে বলী খেলার মঞ্চে উপস্থিত হয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বলী খেলা শুধু একটি খেলা নয়, এটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যুব সমাজকে সংগঠিত করার উদ্যোগ। এটি আমাদের ঐতিহ্য। সকলের সহযোগিতায় এটি ধরে রাখতে হবে। গতবার খেলা হতো না, আমি উদ্যোগ নিয়েছি। এবারও আমি মেয়র হিসেবে চেষ্টা করছি বলী খেলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য। এ মেলায় সঙ্গে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও এই খেলার সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, শতবর্ষ ধরে চট্টগ্রাম যে ইতিহাস লালন করছে ধরে রেখেছে তা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিফলন। এটি অনুপ্রেরণা দেবে তরুণ সমাজকে। এমন সংস্কৃতি অটুট থাকুক। মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, সদস্য সচিব শওকত আনোয়ার বাদল এবং নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, বলী খেলা উদ্যাপন পরিষদ এ নিয়ে ৩ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সোমবার থেকে শুরু হয় বৈশাখী মেলা। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হলো বলী খেলা। আজ হবে চাটগাঁইয়া ঈদ উৎসব।