অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধানমন্ত্রীর উপহার ‘বীর নিবাস’ নিন্মমানের উপকরণ দিয়ে নির্মাণ, কাজে গাফিলতি ও ধীরগতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। নির্মাণকাজে ধীরগতির কারনে ৩ বছরেও ঘরে উঠতে পারেননি অনেক পরিবার। তাঁরা বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো সুরাহা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
সংশিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও প্রয়াত যুদ্ধবীরদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামের এই আবাসন প্রকল্প। মুজিববর্ষ উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রনালয়ের এই প্রকল্পের আওতায় নড়াইলের তিন উপজেলায় (সদরে ৩৯টি, লোহাগড়ায় ১শ ৭৩টি এবং কালিয়ায় ১শ ৪টি) ৩শ ১৬জন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার জন্য এই ‘বীর নিবাস’ নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৮৭টি বীর নিবাসের চাবি গত ১৫ফেব্রæয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ভার্চুয়ালী হস্তান্তর করেছেন। বাকি ২২৯টি নিবাসের নির্মাণ কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান রয়েছে। আগামি ৩১ অক্টোবর এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। প্রতিটি বীর নিবাস নির্মানে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব জায়গার ওপর নির্মিত ৭৩২বর্গফুট আয়তনের এই নিবাসে রয়েছে ২টি বেডরুম, ১টি ড্রইং, ১টি ডাইনিং, ২টি শৌচাগার ও ১টি বারান্দা। এছাড়া ঘরের বিদ্যুতায়নসহ সুপেয় পানির জন্য মটরসহ গভীর নলকুপের ব্যবস্থা রয়েছে।
সদরের দূর্গাপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ইশারত মোল্যা বীর নিবাসের বরাদ্দ পেয়েছেন ২০২০ সালের ৩০জুন। কিন্তু নিবাস নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগে। গত জুন মাসে কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও ৬৫-৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এই মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ, নির্মাণ কাজে অনিয়মের শেষ নেই। ছাদের ঢালাই দেওয়া হয়েছে ৪ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি পুরু । পুরু কম থাকায় এখনই ছাদের তলির কোথাও কোথাও ভিজে ভিজে থাকছে। যে ইট ও খোয়া দিয়ে কাজ হয়েছে তা অত্যন্ত নিন্মমানের। নিষেধ করলেও ঠিকাদার শোনেনি। সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পিআইওকে ২বার লিখিত এবং ৬-৭বার তাদের মৌখিক অভিযোগ জানালেও কোনো কাজ হয়নি। ঠিকাদার কখন কাজ করে আমি জানিনা। আমার সাথে সমন্বয় কাজ করার কথা থাকলেও তা করে না। ঠিকাদারকে ফোন করলেও অধিকাংশ সময় সে রিসিভ করে না। প্রয়োজনে ঠিকাদার, রাজমিস্ত্রীসহ এই অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করবো। দু’এক দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ নিয়ে যাবো।
সদরের ঘোড়াখালী-রঘুনাথপুর মালোপাড়ার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা দুলাল শীলের ২০২০ সালে বরাদ্দকৃত ঘর এখনও কাজ শেষ হয়নি। তিনি জানান, অধিকাংশ নির্মাণ সামগ্রী নিন্মমানের। ঠিকাদার নিজের ‘গোল্ডেন ভাটার’ ৩ নম্বর ইট দিয়ে কাজ করেছে। দু’বছরের বেশী বাড়ির কাজ শুরু হলেও এখনও বৈদ্যুতিক, পানি, রান্নাঘর ও শৌচাগারের সরঞ্জামসহ সংশ্লিষ্ট অনেক খুচরা কাজ করা হয়নি। কাজ যাতে দ্রæত এবং মান ভালো হয় সেজন্য নিজেরাও প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ করেছি। তারপরও কাজের মান নিন্মমানের। ঠিকাদার কখনও কাজের সাইটে আসেননি। লোকজন দিয়ে কাজ করাতে পাঠায়। প্রায় ১ মাস ধরে কাজ বন্ধ।
সদরের মাইজপাড়া ইউনিয়নের চারিখাদা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সালাম শেখের অভিযোগ গত ১৫ ফেব্রæয়ারী থেকে এ বাড়িতে সববাস শুরু করলেও এখনই ছাদের দুই জায়গা দিয়ে পানি পড়ে। থাই জানালা ও কাঠের দরজা ঠিকমতো আটে না। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি প্রবেশ করে। এক রাতের মধ্যে যেনতেন করে ফ্লোর টাইলস লাগানো হয়েছে। বাথরুমের রং উঠে যাচ্ছে। ৮টি বাল্ব লাগানোর ৪দিনের মাথায় সবগুলো কেটে গেছে। ফ্যানের রেগুলেটর নষ্ট। ঠিকাদাররা জানিয়েছিল গত এক বছর কোনো সমস্যা হলে ঠিক করে দেবে কিন্তু তাদের ফোন করলেও আসে না।
শহরের মহিষখোলা এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা খোকন দেবনাথ স্ত্রী বীনা দেবনাথসহ পরিবার নিয়ে গত ১৫ ফেব্রæয়ারী এই বীর নিবাসে উঠেছেন। তাদের অভিযোগ ঘরে ওঠার দু’দিনের মাথায় সমস্ত বাল্ব কেটে গেছে। ইলেকট্রিক তার নিন্মমানের। অনেক সুইচ ঠিকমতো কাজ করে না। পানির ট্যাংকি ফেটে গেছে। বৃষ্টি হলে টিনের বারান্দা দিয়ে পানি পড়ে। মাত্র দু’শ ফুট গভীরতার টিউবওয়েল-এর পানিতে অতিরিক্ত আয়রণ থাকায় এ পানি পান করা যায় না।
লোহাগড়ার রাজুপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক সিকদার বলেন, আমরা খুব কষ্টে আছি। পুরানো ঘর ভাঙ্গা-চোরা হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে ঘর দিয়ে পানি পড়ে। ঝড় আসলে আতংকে থাকি কখন ঘর উড়ে যায়। গত এক বছর আগে কাজ শুরু হলেও এখনও কাজ শেষ হয়নি। এখনও অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
লোহাগড়া উপজেলার খলিশাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অসুস্থ আবুল হোসেনের ছেলে জাকির হোসেন জানান, তার বাড়ির কাজের খুবই নিন্মমান। তিন নম্বর সব মালামাল দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ঠিকাদারকে বললেও তিনি কোনো কর্ণপাত করছেন না। নিজে ইউএনওকে বলেছি। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ বীর নিবাসের বরাদ্দ পাওয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার (সর্বশেষ কমিটি) মির্জাপুর গ্রামের এস এ মতিন, মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সাইদুজ্জামান, তারাপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হোসেন টুকু তুলারামপুর ইউনিয়নের সৈয়দ মহসিন আলী, বাঁশগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা খোকা বিশ^াস, ময়েন ফকিরসহ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার।
ঠিকাদার মাহমুদ পলাশ সদর উপজেলার ১২টি বীর নিবাস নির্মান কাজ করছেন। তিনি কাজের অনিয়ম অস্বীকার করে এ প্রতিনিধিকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা না বুঝে অভিযোগ করছেন। তারপরও কাজে কোনো সমস্যা থাকলে টিক করে দেওয়া হবে। তিনি ইশারত মোল্যার ছাদ সম্পর্কে বলেন, ছাদের কোথাও ২ ইঞ্চি ঢালাই দেওয়া হয়নি।
সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (সর্বশেষ কমিটি) এস.এ বাকি বলেন,বীর নিবাস নির্মাণের ঠিকাদারগণ নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে কাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার পিআইও, ইউএনও-এর সাথে কথা বলেছি। তারা ঠিকাদারের সাথে কথা বলতে বলেন।
লোহাগড়া উপজেলার ডেপুটি কমান্ডার (সর্বশেষ কমিটি) আব্দুল হামিদ বলেন, উপজেলার অধিকাংশ নিবাসের কাজের কোনো গতি নেই। ঠিকাদাররা খেয়াল খুশিমতো কাজ করছে। কাজের মানও নিন্মমানের। আমি নিজে অনেক বাড়ী সরেজমিন দেখতে গিয়েছি। গত ১০-১২দিন আগের খবর কয়েকটি বীর নিবাসের কাজ শুরুই হয়নি। এসব অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত জানানো হয়েছে। কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায় সেজন্য দু’এক দিনের মধ্যে পিআইও এবং ইউএনও মহোদয়ের সাথে বসবো।
সদর উপজেলা বীরনিবাস বরাদ্দ কমিটির সদস্য ও সদর উপজেলা আ’লীগ সভাপতি অ্যাডঃ ওমর ফারুক বলেন, আমি কমপক্ষে ২৫জন ভূক্তভোগি মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে ইউএনও এবং জেলা প্রশাসকের কাছে বীর নিবাস নির্মাণে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ এনে দরখাস্ত করিয়েছি। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। তারা কি এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবে ? মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই খেলা বন্ধ করতে হবে।
মুজিব বাহিনীর সদর থানা কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা শরীফ হুমায়ুন কবির বলেন, অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই বীর নিবাস নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন। বিষয়টি বিভিন্ন মিটিং-এ ইউএনও এবং জেলা প্রশাসককেও জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা দাবি করেন, সদরে ৬টি প্যাকেজে ৬জন ঠিকাদার বীর নিবাসের কাজ করছে। অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সংশিষ্ট উর্ধ¦তন কর্মকর্তারা সার্বক্ষনিকভাবে বীর নিবাসের কাজ দেখাশোনা করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে ইউএনও মহোদয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।
লোহাগড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ ই¯্রাফিল হোসেন বলেন, লোহাগড়া উপজেলা ২৩টি প্যকেজে ১৭৩টি বীর নিবাসের নির্মাণ কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান রয়েছে। তবে এর মধ্যে কয়েকটির কাজ ঈদের আগে শুরু হয়েছে এবং ৩টি জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শুরু করা যাচ্ছে না। ঠিকাদারদের গাফিলতি ও নিন্মমানের কাজ সম্পর্কে বলেন, বীর নিবাস কাজের ঠিকাদারদের নিয়ে ৬-৭ বার ইউএনও মহোদয়-এর সাথে বসে কাজের মান ভালো করতে এবং দ্রæত সময়ের মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আমরা কাজের তদারকি করছি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী বলেন, বীর নিবাস নির্মাণে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে নির্মাণাধীন কয়েকটি বীর নিবাস পরিদর্শন করেছি এবং নির্মাণ কাজের মান যাতে খারাপ না হয় সেজন্য তিন উপজেলার ইউএনদের বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিয়েছি। ঠিকাদাররা আর্থিক বরাদ্দ না পাওয়ায় কাজ কিছুটা বিলম্ব হচ্ছিল। তবে এখন বরাদ্দ পাওয়া গেছে।