সুহার নানা, নানুকে ডাকছে, ‘কই শুনছ’? সুহা নানার ডাকটি শুনে মিটি মিটি হাসে। ওর আব্বা-আম্মুর নাম ধরে ডাকে। ‘জোছনা শুনছ?’ ওর আম্মাও আব্বুর নাম ধরে ডাকে।
নানার ডাক শুনে নানি রান্নাঘর থেকে মাথায় আঁচল চাপিয়ে জবাব দেন, ‘কি বলবেন বলেন। আমার হাতে অনেক কাজ।’
নানা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোছ-দাড়ি ছাটতে ছাটতে বলেন, ‘নাতি-নাতনি পেয়ে এখন আমাকে পর পর ভাবছ। ডাকলেই বল, কত কত ব্যস্ত! বুঝলাম ব্যস্ত, আমিতো এখনো আস্ত।’ নানা কথাটা বলতে বলতে সুহাকে চোখ টিপ মারেন। শাহানও কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল। দু’জনে মিলে খটখটিয়ে হেসে ওঠে।
নানা গলা বাড়িয়ে নানির উদ্দেশে বলেন, ‘বেলা এগারোটা বার মিনিট বেজে গেল এখনো চা খাইনি মনে হচ্ছে। বলি আমি তো আছি, নাকি নাই!’
নানুর গলার আওয়াজ শোনা যায়, ‘চা দিয়েছি এক ঘণ্টাও হয়নি এইতো খালি কাপ বারান্দায় টেবিলে। ঠিক আছে তৈরিই আছে আরেক কাপ পাঠিয়ে দিচ্ছি-’
‘পাঠিয়ে দিবে তবুও নিজে আসবে না।’
‘আচ্ছা আমিই নেমে আসছি-’
নানা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। সুহা শাহানও পেছনে পেছনে। ওদের ধারণা আজ নানা-নানির মজা হবে।
নানি সিঁড়ির শেষ মাথায় নানার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দেন। নানা খপ করে নানির ডান হাত চেপে ধরেন। ঝাঁকি খেয়ে কাপের চা আধা-আধি পড়ে যায়।
সুহা, শাহানের নজর এড়ায়নি। নানি মুখে আঁচল চেপে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলেন, ‘ছাড়েন আমার কাজ আছে। দেখছেন না ওরা মিটি মিটি হাসছে’। এবার নানার পেছনে থাকা সুহা-শাহান খটখটিয়ে হাসতে হাসতে সিঁড়ির রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে।
নানা সুর করে গাইতে থাকেন, ‘আজকে তোরে ঘরে যাইতে দিমুনারে শ্যাম, সোনার বাটায় পান-সুপারি রুপোর বাটায় পান।’
নানি হাত ছাড়িয়ে মুচকি হেসে বলেন, ‘ইস কত ঢং এ বয়সে।’ সুহা-শাহান এবার নানিকে ঘিরে লাফাতে লাফাতে বলে, ‘কি মজা! কি মজা!’
নানুর বাড়িতে আজ চারদিন হলো ওদের। সকালের শীত-কুয়াশা কাটিয়ে ওরা নানার সাথে কিছুক্ষণ পুকুর ঘাটে রোদ পোহালো। নানার গাছের নারকেল, সুপারি পাড়ছে উত্তরবাড়ির কদির বাপ। বিশাল টুকরি করে কদির বাপ আর কালা নারকেল সুপারির স্তূপ গড়েছে উঠানে।
কালা নানার সাথে সারাক্ষণ থাকে, এটা ওটা দেখাশুনা করে। নানা-নানির ফাইফরমাশ খাটে। গায়ের রংটা একটু কালো বলেই ওর মা ওকে কালা বলে ডাকে। কালা মাঝে মধ্যে মার সাথে রাগ করে।
নানা অবশ্য মাঝে মাঝে ওকে সুন্দর কালা বলে ডাকেন ও তখন খুব খুশি হয়। নানা ওকে খুব পছন্দ করেন, ওর কাজ-কাম পরিষ্কার বলে। নানার ইশারাতেই ও সব কিছু বুঝে নেয়।
নারকেল-সুপারির স্তূপ দেখে শাহান, সুহাতো অবাক। এতো এতো নারকেল-সুপারি কি করবেন নানা ওর মাথায় ধরে না। নানির কাছে শুনে ওরা, নানা কিছু রেখে দিবেন, কিছু বিক্রি করবেন, কিছু পাড়া-পড়শীকে দিবেন।
ও বাড়ির তানিয়া, জিনি, মাহি, রাফি, সাফা, ফারহা, সুহাপু সুহাপু বলে ডাকছে। ওরা কালই বলেছে আজ জোলাভাতি খেলবে। দাদুকেও দাওয়াত দিয়েছে।
সুহা শাহানকে নিয়ে উঠানে বের হয়।
নানুর বাড়ির চারদিকে গাছ-গাছালি, সামনে নানির পুঁই শাকের মাচান, বাড়িতে ঢোকার পথে নানা দু’টো লিচু গাছ লাগিয়েছেন, বেশ বড় হয়েছে। গাছের চার পাশ গোল করে পাকা। নানা বিকেলের চা ওখানে বসেই খান। আরো দু’চারজন লোক এলে নানা ওদের নিয়ে ওখানেই বসেন, কথা বলেন।
উঠানের এক কোণে তানিয়ারা ছোট ছোট গর্ত করে নারকেলের অর্ধমালার পাতিল সাজিয়েছে। কোনো মালায় বালু, কোনোটাতে শুকনো খড়, ঘাস, কোনটাতে কুচিকুচি করে কাটা গাছের শুকনো ডাল। একটু পরেই ওদের রান্না আগুন ছাড়া শেষ হয়। এবার গাছের পাতায় বালি, ঘাস, শুকনো ডালের কুচি পরিবেশনা। পাটশলা ভেঙে চামচ বানিয়ে মিছে মিছে খাওয়া। দাদুকেও এক পাতা ধরিয়ে দেয়। দাদু মুখে চপচপ শব্দ তোলে আহ্ কি স্বাদ বল্লেই ওরা হেসে গড়াগড়ি খায়, তানিয়া, মাহি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হাসতে হাসতে। সুহা, শাহানও ওদের দেখাদেখি মিছামিছি খেয়ে হাসছে। খুব মজা হচ্ছে ওদের। শহরে এমন জোলাভাতি খেলার সুযোগ নেই। সবাই সময়ের ঘেরে বন্দি। ওদের বন্ধুও সে রকম নেই যে জোলাভাতি খেলবে, খোলা জায়গায় মজা করবে। বন্ধু মানে লেখাপড়া আর কারো জন্মদিনে কেক খাওয়া। এখানে তানিয়া, মাহিদের পেয়ে ওরা খুব আনন্দ করছে। দুপুরে নানার হাঁকে ওরা ছুটে আসে, আজ ওদের সাঁতার শেখার চতুর্থ দিন। তানিয়া-মাহিরা সাঁতার পুকুরের এপার ওপার করছে, এমনকি ছোট্ট জিনিয়াও সাঁতরে মাঝ পুকুরের গিয়ে ফিরে আসে। সুহা অবাক হয়। নানুর সাথে ঘাটলায় হাঁটু পানিতে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে নাকেমুখে পানি ঢুকে লাফিয়ে উঠছে ওপরে সুহা। তারপর কাশি আর কাশি। দম ফেলে আবারও কাশি।
ছেলেরা বেশি মজা করছে। লাতু, সোহান, হাবু ওরা পুকুরের ওপর ঝুলে থাকা আম গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ছে পুকুরে। অবাক হয়ে শাহান তাকিয়ে থাকে। ওর ইচ্ছে হয় ও নিজেই লাফিয়ে পড়বে। কিন্তু সাহস জাগে না মনে। শাহান ভয়ে ভয়ে এক সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে। নানুর ইসারা পেয়ে শাহানকে কোলে করে এক হাঁটু পানিতে উপুড় করে ধরে কালু। প্রথম প্রথম শাহানের সে কি চিৎকার। এখন হাত-পা ছুড়ে কেবল পানি ছিটাচ্ছে। এক দুইবার পানি খেয়ে দ্রুত উঠে আসে।
আজ বোয়াল মাছ ভাজি দিয়ে মজা করে ভাত খেল সুহা আর শাহান। বাবা গতকাল জেলেদের ধরা ইয়া বড় মাছটি এনেছেন। নানুর মাচার পুঁই শাক আর পুঁটি মাছের আর চর্চরি খুব করে খেল। ওদের মা অবাক হয়ে দেখে। ঢাকায় ওদের না মাছ খাওয়াতে পারে, শাকতো নয়ই। ওরা মাংস ছাড়া কিছইু বুঝে না। মাংস না পেলে খাবার টেবিল ছেড়ে যায়।
মা ভাবছেন, ওরা খোলামেলা জায়গায় দৌড়াদৌড়ি, হড়োহুড়ি করছে, সাঁতার কাটছে তাছাড়া নির্মল বায়ু সেবন করছে- তাই ওদের খাবারে রুচি এসেছে, খিদেও লাগছে।
বিকেল বেলায় নানা একটা দা হাতে ঘরের পেছনে যাচ্ছেন, সুহা-শাহানকেও পেছন পেছন আসতে বল্লেন। ওরাও তৈরি। নানা একটা কলা গাছের গোড়ায় চট্ চট্ দু’টি কোপ বসিয়ে দিলেন। কলা গাছটা হড়হড়িয়ে পড়ে গেল। সুহা একটু দূরেই ছিল সে চিৎকার করে উঠলো ‘নানা নানা তুমি এটা কি করছ? গাছটা কাটলে কেন? সুহার কান্নার ভাব দেখাদেখি শাহানও যেন নাক ফুলিয়ে কেঁদে উঠবে।
নানা গাছের আগার দিকে এগিয়ে এলেন। এক কোপে কলার কাদিটা কেটে তুলে ধরলেন। ‘এই দেখ কায়েকটা কলায় হলদে রঙ ধরেছে। বাকিগুলোও পেঁকে যাবে দু’চার দিনের মধ্যে। কলার ছড়িটা বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখবো। কলা পাঁকবে আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে।
সুহা তখনো গাল ফুলিয়ে আছে। বলে, ‘তাই বলে আস্ত গাছটা কেটে ফেল্লে? শুধু ছড়াটা কেটে নিলেই তো পারতে। গাছটা থাকলে আরো আরো কলার ছড়ি ধরতো।’
দাদু এক গাল হেসে বলেন, ‘সুহামনি তুমি জান না? একটি কলা গাছে এক ছড়িই কলা হয়। এই দেখছ কলার চারা। গাছটা ফল দেয়ার আগেই তার গোড়ায় চারা রেখে যায়। দেখছ আল্লাহর কি কুদরত। বলতে পার এগুলো কলা গাছের বাচ্চা।’
নানা একফালি হাসি দিয়ে সুহার দিকে তাকান। সুহাতো গম্ভীর হয়ে আছে।
যে গাছ একবার ফল দিয়ে মরে যায়, পড়নি বইতে তাকে বলে ওষুধি গাছ। যেমন কলা গাছ, ধান গাছ, গম গাছ, ভুট্টা গাছ। এসব গাছে একবারই ছড়া হয়, ছড়া হলে ছড়া পেকে গাছ মরে যায়।’
‘আবার দেখ ঔষুধি গাছ, যা থেকে নানান রোগের ওষুধ তৈরি করা হয়। আল্লাহ্ বলেছেন, মানব, পশু-পাখির যে সমস্ত রোগ হয় সব রোগের প্রতিষেধক বা ঔষুধ আল্লাহ প্রকৃতির মাঝে রেখেছেন। শুধু আমরা বুঝতে পারিনা। অবশ্য ইদানীং মানুষ আল্লাহর নিদর্শন খুঁজছে গাছ-গাছালি থেকে নানান ঔষুধ তৈরি করছে। তবে হ্যাঁ হাজার হাজার বছর আগে চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল ঔষুধি গাছ নির্ভর।’
‘দাদু কি বল্লে, ওষুধি, আর ঔষুধি তাইতো?
‘ঠিক বলেছ ওষুধি আর ঔষুধির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ঔষুধি গাছ যেমন এই যে দেখ তোমার নানুর রান্না ঘরের পাশে তুলসি গাছ, আদা, রসুন, সাজনা অনেক-অনেক। এমনকি পুকুর পাড়ের জবা ফুল গাছগুলো যে দেখেছ ঐগুলো ঔষুধি গাছ।’
‘তাই দাদু? বইতে পড়েছি কিন্তু এমন করে বুঝিনি।
আজ খেয়াল করেছ, তোমার নানু রান্নাঘরের পাশের সাজনা গাছ থেকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পাতা নিয়ে ভর্তা বানিয়েছে। দুপুরে খেয়েছ তো মজা করে-’
‘তাইতো ধনে পাতার ঘ্রাণে মজা করে খেয়েছি, ওগুলো সাজনা পাতা?’
‘হ্যাঁ তাই অনেক অনেক রোগের ওষুধ।’
‘নানা আম্মু কি এসব জানে?’
‘জানে, হয়তো ভুলেও গেছে। শহরে খুব একটা পাওয়া যায় না। তুমি খেয়াল করেছ আমি দিনে দুই কাপ চা তুলসি পাতা দিয়ে খাই’
‘তাইতো আমি ভাবছি সবুজ চা খাচ্ছ বুঝি?’
তোমরা বই পড়ে অনেক কিছু জানতে পারবে। আসলে চোখে দেখা আর বই পড়ে জানার মধ্যে অনেক পার্থক্য।’
‘নানু তুমি এত কিছু জান?’
‘জানতে হয়, আমরা মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির সেরাজীব। আল্লাহর নির্দেশ তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা তা হলে আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য, মাহাত্ম্য সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।’
‘চল চল সুহা। আমাকে সাহায্য কর। কলার ছড়িটার এদিকটা তোমরা ধর আমি ঐ দিকটা।’
‘কলা গাছটা দুই টুকরা করেছি কেন জানতে চাওনা? ’
‘তাইতো, ভাবলাম এমনি এমনি বুঝি-’
‘না, কলা গাছটার দুই টুকরা পুকুরে ভাসিয়ে দেব। কাল তোমরা দু’জনে ওটা ধরে, সাঁতার কাটবে।’