আজ ১০ আগষ্ট, বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৪ সালের এই দিনে নড়াইলের শ্যামল ছায়া ঘেরা চিত্রা পাড়ের মাছিমদিয়া গ্রামের দরিদ্র রাজমিস্ত্রি মেছের আলীর ঘরে জন্মগ্রহন করেন। বাবা মা আদর করে নাম রাখেন লাল মিয়া।
শিল্পী এসএম সুলতানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী নড়াইলে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (১০আগষ্ট) দিনটি পালন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও এসএম, সুলতান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এস এম সুলতান কমপ্লেক্স (শিল্পীর নিজস্ব বাস ভবনে) কোরআন খতম, শিল্পীর মাজারে পুস্পমাল্য অর্পন, মাজার জিয়ারত, দোয়া মাহফিল, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়।
সকাল নয়টায় শিল্পীর মাজারে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, এসএম সুলতান ফাউন্ডেশন, নড়াইল প্রেসক্লাব, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, এসএম, সুলতান বেঙ্গল চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়, লাল বাউল সম্প্রদায়, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মূর্ছনা সংগীত নিকেতন, ছাত্র পরিষদ সহ সরকারি ও বে-সরকারি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শিল্পীর সমাধিতে পুস্পমাল্য অর্পন করা হয়।
এসময় শিল্পীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। পরে শিশুস্বর্গে শিশুদের অংশগ্রহণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
এসব কর্মসূচিতে নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহম্মদ হাবিবুর রহমান, পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ ফকরুল হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রিয়াজুল ইসলাম, পৌর মেয়র আঞ্জুমান আরা, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম, এসএম সুলতান সংগ্রহশালার কিউরেটর তন্দ্রা মুখার্জী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারন সম্পাদক মলয় কুমার কুন্ডু, নড়াইল প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক শামিমুল ইসলাম টুলু, এস,এম,সুলতান বেঙ্গল চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অনাদি বালা বৈরাগী, এস,এম,সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ হানিফসহ অনেকে এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত: দারিদ্রতার মাঝে বেড়ে ওঠা ‘লাল মিয়া’ তথা এস এম সুলতান ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। শিশু সুলতান স্কুলের অবসরে রাজমিস্ত্রি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন এবং মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন ।
১৯৩৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় জমিদার শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দেন। মুগ্ধ হন শ্যামাপ্রাসাদসহ নড়াইলের তৎকালীন জমিদাররা। পড়ালেখা ছেড়ে ১৯৩৮ সালে চলে যান ভারতের কলকাতায়। চিত্রসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার (সুলতান) পরিচয় হয়। অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ১৯৪৩ মতান্তরে ১৯৪৪ সালে কলকাতা আর্ট স্কুল ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। কিছুদিন কাশ্মীরের পাহাড়ে উপজাতিদের সাথে বসবাস এবং তাদের জীবন-জীবিকা ভিত্তিক ছবি আঁকেন সুলতান।
১৯৪৫ মতান্তরে ১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলায় প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরেও চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ। ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা যান সুলতান। এরপর ইউরোপে বেশ কয়েকটি একক ও যৌথপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লীসহ খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের ছবির পাশে এসএম সুলতানের ছবি স্থান পায়।
১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন সুলতান। শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্বোধন করেন যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইনাম আহম্মদ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় ‘শিশুস্বর্গ’। অবশ্য অনেক আগেই স্বপ্নের শিশুস্বর্গ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এসএম সুলতান।
চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি বাঁশি এবং সুরযন্ত্র বাজাতেও পটু ছিলেন তিনি।
সুলতান বিষধর সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন পশু-পাখি পুষতেন। সুলতান হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি পছন্দ করতেন না।
চিত্রশিল্পের মূল্যায়ন হিসেবে এস এম সুলতান ১৯৮২ সালে ‘একুশে পদক’, ১৯৮৪ সালে ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’ ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা’ এবং ১৯৯৩ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন। এছাড়াও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন।
অসুস্থ্য অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর নড়াইলে প্রিয়জন্মভূমিতে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।