জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী নেতৃত্বে লাখো মানুষের ত্যাগে অর্জিত হয়েছিলো আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। তারপর চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে আমাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। কিন্তু কাঙ্খিত সে লক্ষ্য পুরণ না হওয়ায় স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে গণমানুষের কাছে অনেক দিন পর্যন্ত অর্থবহ হয়ে ওঠেনি।
এ সংগ্রামে আলোকবর্তিকা হিসেবে এসেছে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের ধারক বর্তমান সরকারের প্রণীত দিনবদলের সনদ, যা ২০২১ সাল নাগাদ স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের একটি দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিত করবে। আর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তথ্য প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রসরমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার বিকল্প নেই।
বিষয়টি উপলব্ধি করে রূপকল্প-২০২১ এর সরকার তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রচলিত সেবা প্রদানের ধারার বিপরীতে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জনগণের কাছে সরাসরি সেবা সুলভ করে তোলার জন্য সরকারের এ এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এর অংশ হিসেবে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক সংকট বিবেচনায় সরকার রূপকল্প-২০২১ এ যে বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে তার মধ্যে উলেখযোগ্য হলো তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার নিশ্চিতকরণ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে আইটি শিল্পের উন্নয়ন, মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির শিক্ষাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা, বিজ্ঞান ও গবেষণাকর্মের সুযোগ বৃদ্ধি, আইসিটি খাতের সম্ভাবনাকে সার্থক করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ, দেশের প্রতিভাবান তরুণ ও আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা দিয়ে সফটওয়্যার শিল্প ও আইটি সার্ভিসের বিকাশ সাধনের মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করা।
২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে মাধ্যমিক স্তরে এবং ২০২১ সালে প্রাথমিক স্তরে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলককরণ, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক টাস্কফোর্স সক্রিয় ও কার্যকর করা, দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনকুবেটর ও কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপন করা। যা ইতিমধ্যেই শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা’ এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত সরকারের ভিশন হচ্ছে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশকে পরিপূর্ণরূপে তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এটি নিছক কোন শব্দগুচ্ছ নয়, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচনসহ গণমানুষের আকাঙ্খা বাস্তবায়নে প্রযুক্তির লাগসই প্রয়োগের একটি আধুনিক দর্শন। এ দর্শনের মূল উপজীব্য হলো জনগণের ক্ষমতায়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি সরকারি সেবাসমূহ জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া। এ রোডম্যাপ বাস্তবায়িত হলে জনগণের দোরগোড়ায় শুধু নয়, সরকারি সকল সেবা জনগণের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
ইতিমধ্যে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। সরকারের কোন লক্ষ্য তখনই বাস্তবতার রূপ পায় যখন জনগণ সরাসিরি এর সাথে সম্পৃক্ত হয়। ‘ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা’ জনগণ তথ্য সেবা গ্রহণকারী এবং সেবা প্রদানকারী এক অপূর্ব মিলনমেলা হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে সকল বিভাগে এবং অনেকগুলো জেলায় এই মেলা সফলভাবে আয়োজিত হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা’ করোনার অনেক পূর্বে হয়েছে। এতে শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো এই আয়োজনে অংশ গ্রহণ করেছিলো বিগত দিনগুলোতে। কিন্তু এবার করোনার প্রভাবে তা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সেটাও হলো না।
তবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে বা ইউডিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও অধিকাংশ ইউডিসি এখন আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণ যেমন ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট, মডেম, স্ক্যানার, ডিজিটাল ক্যামেরা, ফটোকপিয়ার, মাল্টি প্রজেক্টর, লেমিনেটিং মেশিন ইত্যাদি দ্বারা সুসজ্জিত। ইউডিসি গুলো বর্তমানে জন্ম নিবন্ধন, ওয়ারিশ সার্টিফিকেট, এনআইডি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, আইন, সরকারি ফরম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল ইত্যাদি সরকারী ও বেসরকারি তথ্য ও সেবা প্রদানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে সকল উদ্যোক্তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। দুর্বল উদ্যোক্তাদের চিহ্নিত করে তাদের জন্য বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হয়েছিলো। প্রতিটি ইউডিসিতে দুইজন করে উদ্যোক্তা থাকার কথা। একজন পুরুষ একজন মহিলা উদ্যোক্তা। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়ে উদ্যোক্তাদের অভাব দেখা গেছে ৬০% এর মতো। কারণ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আর বিবাহজনিত কারণে শিক্ষিত মেয়েরা আসতে অনিহা প্রকাশ করেছে।
সেক্ষেত্রে পুরুষ উদ্যোক্তারা অনেকটাই এগিয়ে এবং সফল। তবে এই সফলতার পেছনে তার রুটি রুজির বিষয়টি মূল সমস্যা। হতাশার কারণে কিংবা বেকারত্বকে সামনে নিয়ে কামড়ে ধরে আছেন ইউডিসিকে। এ ক্ষেত্রে তাদের অনেকের একই কথা- যদি আইসিটি মন্ত্রণালয় থাকতে পারে তাহলে আমরা কেন তাদের আওতায় নেই?
‘নো ওয়াক নো পে’ এই ফর্মুলায় বছরের পর বছর ইউডিসি চলতে পারে না। কিছু না হোক- একটি সম্মানি ভাতা বরাদ্ধ রাখা যেতে পারে। যেমনটা হয়ে আছে চেয়ারম্যান মেম্বারদের বেলায়। এ বিষয়ে চেয়ারম্যানদের অনেক ক্ষেত্রে অনীহা। তারপরেও কিছু কিছু সফল উদ্যোক্তা আছেন নিজেদের অর্থ ব্যয় করে অনেক যন্ত্রাংশ মেরামত করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইউডিসি’র যে সকল যন্ত্রাংশ শুরুতে প্রদান করা হয়েছিল, তা আপডেট কোন হিসাব কেউ নেয়নি। কিভাবে আছে, কেমন আছে তার খোঁজখবর কাউকে নিতে দেখা যায়নি। মাঝে মধ্যে ইউএনও কিংবা ডিসি স্যাররা ইউনিয়ন পরিষদ ভিজিট করতে যান তখন তথ্যকেন্দ্রে ঢু মারেন। মন্তব্য খাতায় মন্তব্য লিখে চলে আসেন। তারপরে আর কোন খোজ খবর নেই।
দেশের অনেক ইউডিসি চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের চট্টগ্রামের ৬টি উপজেলা সহ কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িসহ সন্ধীপ-হাতিয়ার বিস্তীর্ন অঞ্চল। ইউডিসি’র নেটওয়ার্ক সমস্যা, জন্ম নিবন্ধনের সার্ভার পাওয়ার সমস্যা। এরকম অনেক সমস্যা নিরসন সম্ভব হয়নি। স্থানীয় জেলা প্রশাসকের কর্মকর্তারা-দেখছি দেখবো বিষয়টি বলেই বছর পর বছর পার করে দেন। তারপরেও ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র- যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। এর উত্তোরনের জন্য ইউডিসি’র উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত দাবী করে যাচ্ছেন। যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে সংশ্লিষ্ট মহল তাহলে সফলতা আসবে ভিশন ২০২১ এর কনসেপ্ট।
আয়েশা আক্তার/অননিউজ24