‘বাবা কি চকলেট আনতে গেছে?’ চার বছরের আয়াতের এই নিষ্পাপ প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। কিন্তু তার বাবা, চ্যানেল এস-এর রিপোর্টার তরিকুল ইসলাম শিবলী আর কখনো চকলেট নিয়ে ফিরবেন না। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের সরাসরি সম্প্রচার শেষে, শিবলী তার জীবনসঙ্গী সোনিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। শরীর খারাপের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ ঢলে পড়েন তিনি—চিরতরে। পরিবারের অভিযোগ, কাজের সময় কিংবা আর্থিক নিরাপত্তা কিছুই নেই এই পেশায়।
টঙ্গীর স্টেশন রোডের মধুমিতা সড়কের একটি পাঁচতলা বাড়িতে শিবলী ও সোনিয়ার সংসার ছিলো সাধারণ, কিন্তু ভালোবাসায় ভরপুর। ২০০৯ সালে কলেজ জীবনের প্রেম থেকে শুরু হওয়া তাদের দাম্পত্য জীবনে এসেছিল দুই সন্তান—চার বছরের আয়াত এবং দেড় বছরের আজমি। শিবলী ছিলেন পরিবারের একমাত্র সন্তান, তার বাবা একেএম সাহেদুল্লাহ এবং মা আমাতুল গাউসের কাছে একমাত্র ভরসা।
সোনিয়া, ফার্মাসিতে পড়াশোনা করা একজন কর্মজীবী নারী, একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। শিবলীর সাংবাদিকতার অনিয়মিত আয় এবং সোনিয়ার চাকরির সামান্য উপার্জনে চলতো তাদের মধ্যবিত্ত সংসার। কিন্তু অভাবের মধ্যেও অভিযোগ ছিল না। সোনিয়া বলেন, ‘আমরা শুধু স্বামী-স্ত্রী ছিলাম না, ছিলাম বন্ধু, ভরসা।’ রাতে বারান্দায় একসঙ্গে চা খাওয়া ছিল তাদের জীবনের একমাত্র বিলাস। গত বিবাহবার্ষিকীতে সোনিয়ার কেনা কেকে লেখা ছিল, ‘জান্নাতেও তোমার সাথে চা খেতে চাই।’
শিবলীর কাছে তার দুই সন্তান ছিল বেঁচে থাকার প্রেরণা। আয়াত বাসার সামনে একটি প্লে স্কুলে পড়ে। বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোতে খুশিতে উদ্বেল হতো। সন্তানরা বাবার বুকে ঘুমাতো। দেরি হলে মা বলতো, ‘আয়াত ঘুমাবে, তুমি আসছো না কেন?’ সোনিয়ার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে এই স্মৃতি বর্ণনার সময়। তিনি বলেন, আয়াত এখনো বুঝতে পারেনি বাবা আর ফিরবে না।
শিবলীর পেশা ছিল সাংবাদিকতা, যেখানে কাজের সময়ের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ডাকসু নির্বাচনের লাইভ সম্প্রচারের দিন তিনি শরীর খারাপের কথা জানালেও কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরতে অস্বীকার করেন। সোনিয়া বলেন, ‘ওকে বারবার বলেছি, এতো স্ট্রেস নিও না। কারো কিছু হবে না, শুধু আমি আর মেয়েরা কাঁদবো।’ কিন্তু শিবলী তার দায়িত্ব পালনে অটল ছিলেন। লাইভের বিরতিতে সোনিয়াকে শেষ ফোনটি করেছিলেন, বলেছিলেন শরীর খারাপ লাগছে। তবু কাজ শেষ করে অফিসে ফিরে আবার নির্বাচনের খবর সংগ্রহে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর পূরণ হয়নি।
পরিবারের অভিযোগ, সাংবাদিকতার এই পেশায় কাজের সময় বা আর্থিক নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং মানসিক স্ট্রেস শিবলীর মতো অনেক সাংবাদিকের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।
শিবলীর অকাল মৃত্যুতে তার পরিবার ভেঙে পড়েছে। সোনিয়া শিবলীর মৃতদেহের পাশে বারবার চিৎকার করে বলছিলেন, ‘তুমি চোখ মেলো, শুধু তোমাকেই চাই।’ শিবলীর বাবা ৮০ বছর বয়সে বৃদ্ধ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক। তারা ছেলের মৃতদেহ নিয়ে বুড়িচঙ্গের এতবারপুর গ্রামে ফিরেছেন, যেখানে শিবলীকে দাফন করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, আর ঢাকায় ফিরবেন না; ছেলের কবরের কাছেই বাকি জীবন কাটাবেন।
সোনিয়ার সামনে এখন দুই শিশু সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব। কোনো আর্থিক সঞ্চয় না থাকায় তিনি অস্থির। চাকরি চালিয়ে যাওয়া এবং সংসারের খরচ মেটানো তার কাছে এখন বিশাল চ্যালেঞ্জ। তবু তিনি জানেন, মেয়েদের জন্য হলেও তাকে এগিয়ে যেতে হবে। আয়াত এখনো বাবার জন্য অপেক্ষা করে, দরজার বেল বাজলেই দৌড়ে যায়, ভাবে বাবা চকলেট নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই অপেক্ষার আর কোনো উত্তর নেই।
শিবলীর শেষ কিছু দিন ছিল যেন তার বিদায়ের পূর্বাভাস। সোনিয়া বলেন, “ও যেন জানতো সময় বেশি নেই। হঠাৎ মেয়ের জন্য চকলেট, আমার জন্য পাকা পেঁপে কিনে আনতো। বারবার ফোন করে খোঁজ নিতো, যা ওর স্বভাব ছিল না।” এই ছোট ছোট মুহূর্ত এখন সোনিয়ার কাছে অমূল্য স্মৃতি।
সোনিয়া বলছিলেন, কাজের সময়ের কোনো হিসাব নিকেশ ছিলো না এ পেশায়। এতো স্ট্রেস নিতে বার বার নিষেধ করেছিলেন শিবলীকে। বলতেন কারো কিছু হবে না শুধু আমি আর মেয়েরা কাঁদবো। আয়াত, আজমি এখনও বুঝে উঠতে পারেনি বাবা আর ফিরবে না। হারিয়ে গেছে সারা জীবনের জন্যে।
তরিকুল ইসলাম শিবলীর জীবন ছিল ভালোবাসা, দায়িত্ব, এবং সংগ্রামের গল্প। তার অকাল মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়, বরং সাংবাদিকতার পেশার কঠিন বাস্তবতার একটি প্রতিচ্ছবি। তার ছোট্ট আয়াত এখনো জানে না, বাবা আর কখনো চকলেট নিয়ে ফিরবে না। কিন্তু শিবলীর ভালোবাসা তার পরিবারের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
সূত্রঃekattor
আই/অননিউজ২৪।।