গত বছর ২০ অক্টোবর বরুড়ার আদ্রা ইউনিয়নের উপ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে প্রথম কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন আবদুল করিম। সে বার ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের যারপরনাই প্রচেষ্টা এবং নিরলস পরিশ্রমের ফল স্বরূপ ৯টি ওয়ার্ডেই বাজিমাত হয় আব্দুল করিমের। প্রথম বারের মতো আদ্রা ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের কোনো প্রার্থীর জয়লাভ, তা-ও আবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে। সে নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী পারভেজ মাস্টার কেন্দ্রে এজেন্ট না দিতে না পারা, নেতাকর্মীদের উপর হামলা, কেন্দ্র দখলসহ এ যাবতীয় একাধিক অভিযোগে ভোট বর্জন করেন। ফলে ধানের ভরাডুবি হয় বিএনপি অধ্যুষিত ইউনিয়নটিতে।
সে বার আবদুল করিম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার নেপথ্যের প্রধান ভূমিকা ছিল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের। কিন্তু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর দৃশ্যপট বদলাতে থাকে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের। দলের চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ হতে শুরু করে আবদুল করিমের শাসনভার গ্রহণের পর থেকেই। তার বেপরোয়া আচরণের কারণে ছত্রভঙ্গ হতে থাকে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা।
দলকে সুসংগঠিত করার বদৌলতে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের আস্থার জায়গায় ফাটল ধরান তিনি। এক বছরের শাসনামলে সবার সাথে বেপরোয়া আচরণ, খাল খনন করে সে খালের মাটি বিক্রি করা, পরিষদের মেম্বারদের উপর হুকুমত কায়েম করা, হরিশপুরা গ্রামের ৬টি সরকারি খাস পুকুর থেকে মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করা, জন্ম নিবন্ধন সনদে মোটা অংকের অর্থ দাবি, টিআর বরাদ্দ বিক্রি করা, ৪০ দিনের কর্মসূচী আত্মসাৎ সহ এক বছরের শাসনামলে হেন কোন অভিযোগ নেই যা উঠেনি চেয়ারম্যান করিমের বিরুদ্ধে। পরিষদের এক (নাম না প্রকাশের শর্তে) মেম্বারের বেতন আত্মসাৎ, ফেসবুকে তার সমালোচনা করায় জনৈক কাউসার নামক ব্যক্তিকে ফোনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এমনকি নেতাকর্মী দিয়ে তার হাড়গোড় ভেঙ্গে দেওয়ার অডিও রেকর্ড ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। তার বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ফলে ওই ইউনিয়নের সকল মানুষ তাকে " কোপা চেয়ারম্যান" আখ্যা দিয়ে ব্যাঙ্গ ঠাট্টা করছেন। ফলে প্রথম বারের মতো চেয়ারম্যান পাওয়া "নৌকা" র মান সম্মান জলে ডুবেছে। তাতেই ক্ষুব্ধ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের হেভিওয়েট নেতারা।
এসকল কর্মকাণ্ডের বাইরে বিনপি থেকে অনুপ্রবেশকারী, অন্য জেলা থেকে এসে ভূমি ক্রয় করে ইউনিয়নে নতুন বসতি গড়া বাসিন্দাসহ বিতর্কিত ২ লোককে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের ১ জনকে সাধারণ সদস্য এবং অন্যজনকে ১ নং সাংগঠনিক সম্পাদক করে কমিটি গঠন করে দলের ত্যাগী নেতাদের বঞ্চিত করার মতো অভিযোগেও অভিযুক্ত তিনি। এসকল অভিযোগ স্বয়ং আওয়ামীলীগের হেভিওয়েট নেতৃবৃন্দের মুখে মুখে।
তার জাগতিক কর্মকাণ্ডে ফুঁসে ওঠেছেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের তৃণমূল নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ আওয়ামীলীগারেরাও। দলের দুই তৃতীয়াংশ নেতাকর্মীরা তাকে বয়কটের ডাক দিয়ে তাকে আর নৌকা না দেওয়ার অনুরোধ জানালেও, আসছে নির্বাচনেও তার হাতেই ওঠেছে নৌকার দাঁড়। ফলে, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে , সাংসদ নাছিমুল আলম চৌধুরীর নিজস্ব ইউনিয়নে এমন বিতর্কিত, স্বাক্ষর জ্ঞানহীন মাঝির হাতে নৌকা চান নি ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। তবুও তার হাতে নৌকা ওঠায় ক্ষোভ বিরাজ করছে নেতাকর্মী এবং সাধারণ আওয়ামীলীগারদের মনে।
সেই ক্ষোভে শতকরা ৯০ ভাগ নেতাকর্মী করিমের বিকল্প হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী চান। দলটির নেতাকর্মীরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যার যার পছন্দের ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য সমর্থন করে যাচ্ছেন। ফলে, আসছে নির্বাচনে নৌকার জয় নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে। ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের ২৩ টি গ্রামের সমীক্ষায় দেখা গেছে, নৌকা পাওয়া করিমের জনসমর্থন একেবারেই নাজুক। শতকরা ১০ ভাগ আওয়ামীলীগারও করিমকে সমর্থন জানাতে অনাগ্রহী।
এই ইউপি নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন প্রবীণ আওয়ামী নেতারা। দলকে সুসংগঠিত করে সাংসদ নাছিমুল আলম চৌধুরীর হাতকে শক্তিশালী করার বদৌলতে করিম চেয়ারম্যান ইস্যুতে দলটির মেরুদণ্ডে হাড়ক্ষয় অবস্থা দেখা দিয়েছে। ফলে বিএনপি অধ্যুষিত এ এলাকায় আওয়ামী রাজনীতির মোড় ঘুরে যাচ্ছে। দলের এই মধুমাস সময়ে সুসংগঠিত না থাকতে পারলে কখনো দুঃসময় আগত হলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হতে পারে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের। এমনটাই মনে করছেন ইউনিয়নের প্রবীণ আওয়ামী নেতারা।
এসকল আশংকার কথা জানিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল ওহাব, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন মাস্টার, আলী নেওয়াজ মজুমদার, বর্তমান সহ সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন মজুমদারসহ বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রবীণ আওয়ামীলীগার।
তারা জানান, অনেক আশা ভরসা করে করিমকে গেলো বার চেয়ারম্যান বানিয়েছে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ, কিন্তু করিম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আমাদের আশায় মরিচীকা ঢেলেছেন, দলকে সুসংগঠিত করে নাছিমুল আলম চৌধুরী নজরুল সাহেবের হাতকে শক্তিশালী করার বিপরীতে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন করিম। আসছে ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ করিমকে আর চেয়ারম্যান হিসেবে চান না বলে কয়েকজন প্রবীণ নেতা প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যের কাছে একটি ভিডিও বার্তা প্রেরণ করেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তবুও তাকেই নৌকার জন্য মনোনীত করায় তৃণমূল আওয়ামীলীগ হতাশ। দলের নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার আশংকা করছি আমরা, যা পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে।
আহসানুজ্জামান সোহেল/অননিউজ24।।