কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে চলছে ইটভাটা। কুষ্টিয়া জেলায় ১৭০টি ইটভাটার মধ্যে ১৪৮টি ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। এদের মধ্যে ভেড়ামারায় ৩৪টি ইট ভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ইটভাটায় করাত কল দিয়ে কাঠ ফাড়ানো হচ্ছে। এবছর ভেড়ামারা উপজেলায় কোন ভাটায় অভিযান পরিচালা হয়নি। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ও ফসলি জমিতে স্থাপন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। আইন অমান্য করে দিনের পর দিন ইটভাটার সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ইটভাটার সংখ্যা ১৭০টি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে চলছে ২২টি ইটভাটা। বাকি ১৪৮টি ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অধিকাংশ ইটভাটা পরিচালিত হয়। অধিকাংশ ইটভাটায় কয়লার বদলে পুড়ছে কাঠ। অবৈধভাবে ভেড়ামারায় ৩৪টি ইট ভাটা ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে। অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) ২০১৯ অনুযায়ী, বিশেষ কোন স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরুপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে।
ভেড়ামারা উপজেলার ইটভাটায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের চোখের সামনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে, ঘনবসতি এলাকায় ও ফসলের মাঠের কৃষি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটায় পরিবেশ বান্ধব কয়লার বিপরীতে অবাধে কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। অবৈধ ট্রলির মাধ্যমে আশপাশের এলাকার ফসলি জমির মাটি এনে তৈরি করা হচ্ছে ইট। অবৈধ ইটভাটার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে মানুষ। শুধু তাই নয় নদী ও সরকারি জায়গায় প্রভাবশালী কয়েকজন গড়ে তুলেছেন ইটভাটা। এছাড়া সরকারি জায়গার মাটি কেটে ইট ভাটায় নিয়ে যাওয়া হয়। ভেড়ামারা উপজেলার ৩৪ টি ইটভাটা ব্যবসায়ী দিনে ও রাতের আধারে ড্রাম ট্রাক ও শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ট্রলিতে করে বিভিন্ন স্থান থেকে মাটি এনে ইটভাটায় ব্যবহার করছেন। সড়কগুলোতে এসব অবৈধ যানবাহনের বে-পরোয়া চলাচলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন ইটভাটা মালিক বলেন, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটাগুলো প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালানো হয়। তাছাড়া ভ্যাটও দেওয়া হয়। অবৈধ ইটভাটা মালিকদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়। প্রত্যেক ইটভাটা থেকে কমিটির নেতারা প্রতি বছর ১ লাখ টাকা খেকে ২ লাখ টাকা আদায় করে থাকে। তারা সেই টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। এভাবেই নির্বিঘেœ ইটভাটা চালাই সবাই।
হাবিবা বেগম বলেন, ভেড়ামারা সাতবাড়িয়া খান পাড়া এলাকায় খান পরিবার তাদের শত বছরের আম বাগান কেটে ভাটা তৈরি করেছে। শত বছরের আম গাছ গুলো সবই তাদের ইট ভাটায় পোড়ানো হয়েছে। ভাটার পাশে আমাদের বাড়ি হওয়ায় ধোঁয়া ও ধুলাবালিরর কারণে বাচ্চাদের অসুস্থ্য লেগেই থাকে।
কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, আইন আছে কিন্তু কেউ মানে না। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। প্রতিবছরের মতো এবারও ইট তৈরির মৌসুমে প্রতিদিন ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এছাড়া ফসলি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। ধোঁয়া ও ধুলাবালিরর কারণে ফসল ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
এলাকাবাসী জানায়, ইটভাটাগুলোর লাইসেন্স না থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়া অজ্ঞাত কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকাশ কুমার কুন্ডু বলেন, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
কুষ্টিয়া জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মাণের অনুমতি কৃষি বিভাগ থেকে দেওয়া হবে না। কৃষি জমিতে ইটভাটা হলে কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভাটায় কাঠ পোড়ানোর কারণে ফসলের ফলন বিপর্যয় ঘটে। কৃষি জমিতে ইটভাটা করলে কৃষি জমির ফলন হ্রাস পায়।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এ এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলাবালি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ধুলাবালি শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করলে এজমা ও এলার্জি রোগ হয়। ফলে ইটভাটার আশপাশে বসবাসরত মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দেখা যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হাবিবুল বাশার বলেন, অবৈধ সব ইটভাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ভেড়ামারায় ৩৪টি ইট ভাটায় মধ্যে ২-১ টা বাদে সব গুলো ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। কুষ্টিয়ায় ১৭০টি ইটভাটার মধ্যে ১৪৮টি ভাটাই অবৈধ। বাকি ২২টি বৈধ। সব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে।
এফআর/অননিউজ