কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষ মাস। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ডামাডোলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০২৪ সালে আরেকটি মন্দার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব, এমন সতর্কবার্তা যখন শোনা যায়, তখন পূর্ব ইউরোপের ছোট্ট দেশ জর্জিয়া শোনাচ্ছে ভিন্ন গল্প। যুদ্ধ যখন ইউরোপকে শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতিতে রেখেছে তখন, রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশটিতে অপ্রত্যাশিতভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে।
সম্প্রতি জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি গারিবাসভিলি বলেন, ডাবল ডিজিটে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে দেশটিতে। সাপ্তাহিক বৈঠকে তিনি আরও বলেন, গত ৯ মাসের মধ্যে প্রবৃদ্ধি এখন ১০ দশমিক ২ শতাংশ।
জানা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে একটি হলো জর্জিয়া। কীভাবে এই নাটকীয় পরিবর্তন খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর প্রেসিডেন্ট পুতিনের বাধ্যতামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ এড়াতে এক লাখের বেশি রুশ নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে দেশটিতে। এতে গতি ফিরেছে দেশটির অর্থনীতিতে। ফলে মন্দার প্রভাব তো দূর উল্টো বাড়বাড়ন্ত দেশটির অর্থনীতির।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনের তথ্য বলছে, কৃষ্ণ সাগরের সীমান্তবর্তী দেশটির জনসংখ্যা ৩৭ লাখ। ২০২২ সালের দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ রেকর্ড করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জর্জিয়ার ভূমি প্রকৃতি বিচিত্র ধরনের। সুউচ্চ পর্বতমালা ও উর্বর উপকূলীয় নিম্নভূমি রয়েছে দেশটির। ১৯২২ সালে জর্জিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয় দেশটিতে। এসব ঘটনার কারণে, একই সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ফলে জর্জিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামে। তবে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় রাজনৈতিক সংঘাত কমে গেলে ও মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। ভিয়েতনাম ও কুয়েতের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করা যায় দেশটির অর্থনীতিকে।
দেশটির বৃহত্তম ব্যাংক টিবিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ভাখতাং বুতসক্রিকিদজে রয়টার্সকে তার তিবিলিসি সদর দফতরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে, জর্জিয়া খুব ভালো করছে। তিনি আরও বলেন, সব শিল্প প্রতিষ্ঠানই বিশেষ করে ক্ষুদ্র থেকে করপোরেট পর্যন্ত সবগুলো প্রতিষ্ঠান খুব ভালো করছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না কোনও প্রতিষ্ঠান এ বছরে কোনও ধরনের সমস্যায় পড়বে’।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গত আট মাসে জর্জিয়ায় আশ্রয় নেওয়া রুশ নাগরিকদের সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজার। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পরপরই ৪৩ হাজার মানুষ প্রবেশ করে দেশটিতে। গত সেপ্টেম্বরে, জর্জিয়ায় প্রবেশ করে আরও অনেকে।
জর্জিয়ার অর্থনৈতিক উত্থান স্বল্পস্থায়ী না দীর্ঘস্থায়ী হবে সেটি নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য ও পর্যটনখাত দেশটির অর্থনীতিতে টেকসই ভূমিকা পালন পারে।
ইউরোপীয় ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইবিআরডি) গত মার্চ মাসে পূর্বাভাস দিয়েছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ জর্জিয়ার অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা দেবে। একইভাবে বিশ্বব্যাংক গত এপ্রিলে পূর্বাভাস দেয় ২০২২ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি প্রাথমিকভাব ৫ দশমিক ৫ থেকে আড়াই শতাংশে নেমে আসবে।
ককেশাস ও পূর্ব ইউরোপবিষয়ক ইবিআরডির প্রধান অর্থনীতিবিদ দিমিতার বোগভ বলেছেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ জর্জিয়ার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমন ধারণা থাকলেও এখন পর্যন্ত আমরা এই ঝুঁকিগুলোর বাস্তব রূপ দেখতে পাচ্ছি না। বরং জর্জিয়ার অর্থনীতি এ বছর বেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে নাটকীয় এ প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে না দেশটির সব শ্রেণিপেশার মানুষ। বরং জীবিকা নির্বাহে অনেকের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়েছে। বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। এমনকি বাড়ি ভাড়াও বেড়েছে দেশটিতে। তাছাড়া রুশ শিক্ষিত, প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন লোকজন প্রবেশ করায় স্থানীয়দের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যবসায়ী নেতারা উদ্বিগ্ন যে যুদ্ধ শেষ হলেও এসব রুশ নাগরিককে দেশে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে জর্জিয়ার পক্ষে।
রাশিয়ার সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দক্ষিণ ওসেটিয়া ও আবখাজিয়া নিয়ে ২০০৮ সালে খোদ জর্জিয়া রাশিয়ার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ জড়িয়ে পড়েছিল।
এখন, যদিও জর্জিয়ার অর্থনীতি পরাশক্তির সঙ্গে তার সুসম্পর্কের সুফল পাচ্ছে। উভয় দেশের মধ্যে একটি স্থল সীমান্ত ক্রসিং রয়েছে। একই সঙ্গে একটি উদার অভিবাসন নীতি রয়েছে যাতে রাশিয়ান এবং অন্যান্যরা সহজে যাতায়াত করতে পারে দেশটিতে। তবে অর্থনীতির এমন অবস্থা ধরে রাখতে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র: ডেইলি সাবাহ, দ্য স্টার