মুদিদোকানীর ছেলে রিফাত মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেলেও খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরিবার

হিলি প্রতিনিধি

দিনাজপুরের হিলিতে সকল প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মুদিদোকানীর ছেলে অদম্য তরুন মেধাবী শিক্ষার্থী রিফাত ইসলাম। কুমিল্লা সরকারী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে সে। কিন্তু অর্থ সংকটে সেই স্বপ্নপূরণ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভর্তিসহ পড়ালেখার খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পরিবারের কপালে। তার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নিতে সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান। চিকিৎসক হয়ে সম্পুর্ন বিনামুল্যে এলাকাবাসীর চিকিৎসা প্রদানের আশ্বাস রিফাত ইসলামের।

উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন গ্রামটির নাম মাঠপাড়া। সেখানেই সেমিপাকা ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করেন রিফাতের বাবা-মা। দুই ভাই এর মধ্যে রিফাত বড়। ছোটভাই ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ালেখা করে। বাবা আমিন ইসলাম গ্রামের ছোট্ট মুদিদোকানী হওয়ায় সেই ছোট থেকেই অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠা তার। একারণে ভালো কোনো স্কুলে পড়ার সুযোগ ছিল না তার। শিশু শ্রেনীতে তাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে গ্রামের একটি ব্র্যাক স্কুলে। এরপর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়ে পিএসসিতে জিপিএ-৫ ও সাধারন গ্রেডে বৃত্তি এবং একই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে জিপিএ-৫সহ ট্যালেন্টপুলে বৃক্তি পেয়ে ভর্তি হয় বাংলাহিলি পাইলট স্কুল এন্ড কলেজে। ২০১৮ সালে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করে বাহিরে পড়ালেখার ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অভাবের কারনে ভর্তি হয় স্থানীয় হাকিমপুর সরকারী কলেজে। ২০২১ সালে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে রিফাত। অভাবের কারণে কোনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগ হয়নি তার। অন্যোর কাছ থেকে পুরনো ও নতুন বই ধার নিয়ে শিক্ষকদের সহায়তায় প্রস্তুতি নেয় ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষায়। অবশেষে ২৭৫.৭৫ নম্বর পেয়ে চান্স পায় কুমিল্লা সরকারী মেডিকেল কলেজে। অভাবকে জয় করে একজন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন তাড়া করছে রিফাতকে।এদিকে রিফাতের এই সাফল্য হিলিবাসীর জন্য বড় পাওয়া বলে আনন্দে ভাসছে গ্রামের মানুষ, শিক্ষকসহ শুভাকাঙ্খীরা। এদিকে হিলির ইশরাত জাহান তিথি নামের এক কৃতি ছাত্রী দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পাওয়া রিফাত ইসলাম বলেন, আমি নিজে যেহেতু একজন গরীব পরিবার থেকে এই অবস্থায় এসেছি মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি।সেহেতু আমি জানি একজন গরীব মানুষ সে কি অবস্থায় থাকে। যে কিনা কষ্ট দেখবেনা সে কখনোই বুঝবেনা তাদের কষ্টটা কেমন। আমি নিজে যেমন এত কষ্ট করে ওই স্থানে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে যখন আমি একটি মানুষকে দেখবো তখন জানবো বুঝবো আমিও একসময় এই অবস্থায় ছিলাম তখন আমি বুঝবো যে আমি তাদের জন্য কি করতে পারবো কারন আমি এমন ছিলাম। এটা আমার বাবা মা আমার পরিবার বা আমার পাড়া প্রতিবেশী তাই আমাকে তাদের দেখতে হবে। আমি যেদিন থেকে ভেবেছি আমি একজন ডাক্তার হবো সেদিন থেকেই আমি সিন্ধান্ত নিয়ে রেখেছি সকলের দোয়াই পড়াশোনা শেষ করে একজন বড় ডাক্তার হতে পারি। সেক্ষেত্রে আমার গ্রামে একটি চেম্বার থাকবে। সেটি আমি দেশের যেখানেই থাকি না কেন মাসে একবার হলেও সম্পুর্ন বিনামুল্যে আমার এলাকার মানুষকে চিকিৎসা দেবো।

রিফাতের মা লাভলী বেগম বলেন, ছেলে চেষ্টা করেছে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে যার জন্যই সুযোগ পেয়েছে। আমার ছেলে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এতে করে মা হিসেবে আমার খুব ভালো লাগছে এটিতো গর্বের বিষয়।

রিফাতের বাবা আমিন ইসলাম বলেন, আমার যে আয় তাতে করে আমার ছেলেকে পড়ালেখা করানো কোনভাবেই সম্ভব ছিলোনা। আল্লাহপাক আমার ছেলের মেধা দিয়েছে সাথে শিক্ষকদের সহযোগীতায় এতদুর আসতে পেরেছে। আজ যে আমার ছেলে মেডিক্যালে সুযোগ পেয়েছে কিন্তু ভর্তিসহ মেডিক্যালে পড়ার যে খরচ আছে আমার কোন সম্পদ বা জমাজমি কোন কিছু নেই যা দিয়ে খরচ চালাবো। কষ্ট করে যেভাবে এতদুরে আসছে এভাবেই সামনের দিকে যেতে হবে তাছাড়া কোন উপায় নেই।

এলাকাবাসী নাজমা বেগম বলেন, সে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে আমরা তাকে সবসময় সাহস দিতাম ভালোভাবে পড়ালেখা করতে বলতাম। টাকার জন্য পড়ালেখা থেমে থাকবেনা আজ সেই কষ্টের ফল সার্থক হয়েছে। গ্রামে থেকে মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়েছে এটাইতো বিশাল এটা আমাদের গর্ব। দোয়া করি পড়ালেখা শেষ করে ভালো একজন ডাক্তার হোক।

স্কুল শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, রিফাত অনেক মেধাবী ছাত্র তার মধ্যে একটা ইচ্ছা শক্তি ছিল হ্যা আমি পারবো যার কারনে আমরা তাকে সবসময় উৎসাহ দিয়েছি। তার কাছ থেকে সবসময় আমরা পজিটিভ কিছু পেয়েছি। সে ছাত্র হিসেবে অনেক ভালো ছেলে হিসেবেও অনেক ভালো। আমি চাই সে তো অবশ্যই এমবিবিএসে ভর্তি তো হবেই সে এফসিপিএস সম্পুর্ন করবে দেশ ও জাতির সেবা করবে।

হাকিমপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক আলি ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমার মনে হয় দুনিয়াবী কোন ধারনা ওর নেই শুধু বই বই আর বই। প্রতিদিন রাত ১২টা অবধি পড়াশোনা করতো নিয়মিত ভাবে। আমি তাকে একজন পড়ুয়া ছাত্র হিসেবেই পেয়েছি। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ভালো কিছু করবে এই চিন্তা চেতনা সবসময় তার মধ্যে কাজ করতো বলেই সম্ভব হয়েছে।

হাকিমপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ বলেন, টাকা থাকুক আর না থাকুক এটি পড়ালেখার ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। ইচ্ছা শক্তিই যে বড় শক্তি মেডিকেলে চান্স পেয়ে সেটিই প্রমান করেছেন রিফাত ইসলাম। সে যেন মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করতে পারে দেশের একজন ভালো চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এজন্য তার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সবধরনের সহযোগীতা করা হবে বলেও জানান তিনি।

আরো দেখুনঃ