যে কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এরদোগান গুরুত্বপূর্ণ

নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে টানা তৃতীয়বারের মত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রজব তাইয়েব এরদোগান। নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোটে বিজয়ী হওয়ার এরদোগানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলতসও, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষনেতারা।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এরদোগান পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে অভিনন্দন জানাতে আন্তর্জাতিক নেতাদের মধ্যে যেভাবে তাড়াহুড়ো লেগে গিয়েছিল তা থেকে বিশ্বে তুরস্কের কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। খবর বিবিসি বাংলার।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট ৬৯ বছর বয়সী এরদোগান দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং এই ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পারায় তাকে অনেক আগেভাগেই অভিনন্দন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এবিষয়ে পুতিন এতোটাই উৎসাহী ছিলেন যে তিনি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করা পর্যন্তও অপেক্ষা করেন নি। সরকারিভাবে ফল ঘোষণার আগেই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, এরদোগানের ‘নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি’ তার বিজয়ের অন্যতম একটি কারণ।

ইউক্রেনে পুরোদমে সামরিক অভিযান শুরু করার পর নেটো জোটে তুরস্কের মিত্র দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং এসব দেশ রাশিয়ার ওপর তাদের জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান তখন ক্রেমলিনকে পরিত্যাগ করে তাকে একঘরে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন একারণে এরদোগানকে পছন্দ করতেই পারেন।

এছাড়াও ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের ব্যাপারে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছেন। এবিষয়ে কিছুটা আলোচনাও হয়েছিল। জাতিসংঘের উদ্যোগে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ চলাচলের বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া এক সমঝোতাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল প্রেসিডেন্ট এরদোগান নেতৃত্বাধীন তুরস্কের। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক নেতাদের মধ্যে শুধু যে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনই এরদোগানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তা নয়। এই দৌড়ে পিছিয়ে থাকেন নি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁও। জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জার্মানি, নেটোর পক্ষ থেকেও এরদোগানের বিজয়ে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।

এরদোগানের বিজয়ের পর তাকে অভিনন্দন জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক টুইট বার্তায় বলেছেন, বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা একসঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখার দিকে তাকিয়ে আছি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেছেন, ‘ফ্রান্স এবং তুরস্ককে অনেক চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপে শান্তি ফিরিয়ে আনা, ইউরো-আটলান্টিক জোটের ভবিষ্যৎ, ভূমধ্যসাগর। পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় আমি প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে অভিনন্দন জানাই, আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখবো।’

বিবিসির ইউরোপ বিষয়ক সম্পাদক কাটিয়া এডলার বলছেন, পশ্চিমা নেতারা ক্রেমলিনের সঙ্গে এরদোগানের এই ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করেন না, পছন্দ করেন না তার দুই দশকের শাসনামলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে খর্ব করার মতো বিষয়গুলোও, কিন্তু তারপরেও তুরস্ক তাদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, যদিও এই সম্পর্ক অনেক কঠিন। পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট নেটোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশ তুরস্ক। নেটোর সব অভিযানেই এই দেশটি অংশ নিচ্ছে।

কাটিয়া এডলার বলছেন, এরদোগান হয়তো রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন, কিন্তু একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেনকে তিনি সামরিক সাহায্যও দিয়ে আসছেন। ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির ওপর রাশিয়া যে অবরোধ আরোপ করেছিল সেটা তুলে নেওয়ার ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এই মধ্যস্থতার কারণে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের জন্য ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল। এই সমঝোতার কারণে এসব দেশে ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও তাদের খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে পারছে।

নেটো সম্প্রসারণের ব্যাপারেও তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই জোটের সংবিধানে বলা হয়েছে, নতুন কোনো দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে জোটের সকল সদস্যের সম্মতির প্রয়োজন। কোনো একটি সদস্য দেশ আপত্তি জানালে কাউকে এই জোটের সদস্য করা যাবে না। সম্প্রতি ফিনল্যান্ড ও সুইডেন নেটো জোটের সদস্য হওয়ার যে আবেদন জানিয়েছিল সেবিষয়ে সবার দৃষ্টি ছিল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের দিকে। অনেক দ্বিধা ও সংশয়ের পর শেষ পর্যন্ত তিনি রাশিয়ার প্রতিবেশি দেশ ফিনল্যান্ডের নেটোতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিয়েছেন। ফলে ফিনল্যান্ড এখন নেটোর সদস্য। কিন্তু সুইডেনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনও ঝুলে রয়েছে।

এই সুইডেনও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টেনসন টুইট করে বলেছেন এই দুটো দেশের “নিরাপত্তাই” তাদের ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকার। তুরস্ক যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে পারে সেজন্য একসময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রচুর চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তার সেই লক্ষ্য এখনও সফল হয়নি। তবে ইদানিং তিনি ইইউতে যোগদানের ওপর খুব বেশি জোর না দিয়ে বরং তুরস্ককেই “আবারও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র” হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলছেন।

বলা যায় যে প্রেসিডেন্ট এরদোগান তুরস্কের জন্যে একটি ‘নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ তৈরি করতে পেরেছেন এবং তিনি সে অনুযায়ীই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। সহজ করে বললে বলতে হয় যে প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার সব মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে গড়ে তুলেছেন “লেনদেনের সম্পর্ক।” এসব সম্পর্কের পেছনে তিনি তুরস্কের স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এছাড়াও তুরস্কের কৌশলগত গুরুত্বকে পশ্চিমা দেশগুলো ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর তুরস্কের এই অবস্থান বদলে গেছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোগানের আরেক মেয়াদের শাসনামলে তার দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে সেই সম্ভাবনা খুব কম। তবে আঙ্কারার কৌশলগত মিত্র দেশগুলো এই সরকারের ওপর যে এবিষয়ে গভীর নজর রাখবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এফআর/অননিউজ

আরো দেখুনঃ