দেশের মানুষের কাছে শীতকাল মানেই ভ্রমণের মৌসুম। প্রতিবছর শীতের মৌসুম তথা নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারিতে প্রকৃতি তার চিরাচরিত নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ফিরে পায়।
সেই সৌন্দর্যের মোহে সারা দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে বেড়ানোর ধুম লেগে যায়। চলতি বছর শীতের হাওয়া লেগেছে মাসখানেক।
এরই মধ্যে ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরতে বেড়িয়েছেন। এবারের শীতে দেশের কোন কোন স্থান ঘুরতে যাবেন জেনে নিন-
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতে সারা বছরই পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকে। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে যেকারও মন ভালো করে দেয়। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাটা দিন।
এখন ঢাকা-কক্সবাজারে সড়ক ও আকাশপথে সরাসরি যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, কলাবাগান, সায়েদাবাদ থেকে অধিকাংশ পর্যটক বাসে কক্সবাজার যান। যেতে সময় লাগে ৮-১০ ঘণ্টা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনস, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার দিনে ২০টির বেশি ফ্লাইট কক্সবাজারে পরিচালনা করে। এর মধ্যে গত ৩০ নভেম্বর যশোর-কক্সবাজার রুটে সরাসরি ফ্লাইট শুরু করেছে নভোএয়ার।
ফলে এক ঘণ্টারও কম সময়ে কক্সবাজার যেতে পারছেন পর্যটকরা। এছাড়া আগামি বছরের জুনে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেন যোগাযোগ শুরু হবে। তখন রেলপথেও স্বাচ্ছন্দে ও কম সময়ে কক্সবাজার যাওয়া যাবে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সর্ব দক্ষিণের মাত্র ১৭ বর্গ কিলোমিটারের এই ক্ষুদ্র দ্বীপটির অবস্থান কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে।
একদিকে নিঃসীম নীল দিগন্তের কোণে ফেনিল সমুদ্রের মিশে যাওয়া, অন্যদিকে সারি সারি নারিকেল গাছ ঘেরা সাধারণ জীবন ভ্রমণপিপাসুকে অমোঘ আকর্ষণে কাছে টানে।
সেন্টমার্টিন যেতে হলে ঢাকা থেকে প্রথমে কক্সবাজার যেতে হবে। সেখান থেকে নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিওটিএ ঘাট থেকে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস নামের জাহাজটি সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
গত ৬ অক্টোবর থেকে এই সেবা চালু হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম-সেন্টমার্টিনের মধ্যে চলাচল করে ‘এমভি বে ওয়ান’ নামে আরেকটি ক্রুজশিপ। আগে টেকনাফ থেকে ক্রুজশিপ করে সেন্টমার্টিনে যাওয়া যেত।
তবে গত সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি ও নাফ নদীর বিভিন্ন স্থানে ডুবোচর দেখা দেওয়ায় সাগরপথে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
কুয়াকাটা
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দর্শনীয় স্থান কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকতের অবস্থান পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার অন্তর্গত লতাচাপলি ইউনিয়নে।
কক্সবাজারের মতো অভিজাত না হলেও, এখানকার নিরিবিলি বেলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল কুয়াকাটাকে করেছে অনন্য।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার উপায় হচ্ছে নদী ও সড়ক পথ। এর আগে সবাই ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে পটুয়াখালী বা বরিশাল হয়ে বাকি পথ বাসে কুয়াকাটা যেতেন।
তখন লঞ্চ ও বাসে করে আধাবেলা লেগে যেত। তবে এখন পদ্মা সেতুর কারণে মাত্র ৫ ঘণ্টায় বাসে করে সরাসরি পৌঁছনো যায় কুয়াকাটায়।
সুন্দরবন
বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী এবং ভারতের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন।
বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃত এই বনাঞ্চলটি বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণের আধার। এখানে জন্মানো সুন্দরী বৃক্ষের কারণে সুন্দরবন নামেই বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের এই প্রধান বিচরণক্ষেত্রটি।
এখানে ঘুরতে যেতে হলে অবশ্যই বন অধিদপ্তরে নির্ধারিত ফি দিয়ে অনুমতি ও সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে নিতে হয়। এর সবগুলো দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার একমাত্র মাধ্যম লঞ্চ ও ছোট জাহাজ।
সুন্দরবন সাধারণত সবাই খুলনা বা মোংলা হয়ে যেত। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে এখন সড়কপথেই সুন্দরবন ভ্রমণে যেতে পারছে দেশের হাজারো মানুষ।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
১২৫০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও আংশিক শ্রীমঙ্গল নিয়ে। দেশের ট্রপিকাল রেইন ফরেস্ট হিসেবে খ্যাত এই জাতীয় উদ্যানটি জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর নান্দনিক সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন।
৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২৪০ প্রজাতির পাখির আশ্রয়স্থল এই লাউয়াছড়া। বিশেষ করে বিলুপ্ত প্রায় উল্লুকের সবচেয়ে বড় বিচরণ এলাকা হিসেবে এর সুখ্যাতি আছে। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে করে শ্রীমঙ্গল পৌঁছে লাউয়াছড়া ভ্রমণ করা যায়।
কুতুবদিয়া দ্বীপ
বাংলাদেশে বাতিঘর দেখতে হলে চলে যেতে হবে কক্সবাজার জেলার ছোট উপজেলা কুতুবদিয়ার এই দ্বীপটিতে। এখানকার প্রাচীন বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষটি এখনো যেন ভাটার সময় পুরানো ইতিহাসের গল্প বলে।
২১৬ বর্গ কিলোমিটারের ছোট এই দ্বীপে আছে নির্জন সমুদ্র সৈকত ও কুতুব আউলিয়ার মাজার। বাংলাদেশের একমাত্র বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও প্রাকৃতিকভাবে লবণ চাষের জন্য এ জায়গাটি বেশ প্রসিদ্ধ।
এই দ্বীপ ভ্রমণের জন্য কক্সবাজার থেকে প্রথমে চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড আসতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি করে মগনামা ঘাট পৌঁছে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে নেমে পড়তে হবে কুতুবদিয়া চ্যানেলে। আর এই কুতুবদিয়া চ্যানেলই পৌঁছে দিবে কুতুবদিয়া দ্বীপে।
মনপুরা দ্বীপ
ভোলা জেলার এই বিচ্ছিন্ন ভূমিটি সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত এবং হরিণ দেখার জন্য পর্যটকদের প্রিয় স্থান মনপুরা দ্বীপ। মেঘনা নদীর ভেতরে ৫০০ মিটার পর্যন্ত স্থাপন করা মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশনে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকদের ভীড় থাকে।
দ্বীপ ভ্রমণে এসে দর্শনার্থীরা চৌধুরী প্রজেক্টের মাছের ঘের আর সারি সারি নারিকেল গাছের বিস্তৃত এলাকাতেও ঘুরতে আসেন। নদীর ধারে সাইক্লিং কিংবা সবুজের মাঝে ক্যাম্পিং-এর জন্য সেরা জায়গা মনপুরা দ্বীপ।
মনপুরা দ্বীপে যাওয়ার জন্য ঢাকার সদরঘাট থেকে বিকেল ৫টায় লঞ্চে উঠে পড়তে হবে। এছাড়া ঢাকা থেকে থেকে সড়ক পথে ভোলা হয়ে তজুমদ্দিন ঘাটে এসে সি-ট্রাকে করেও মনপুরা দ্বীপে আসা যায়। সি ট্রাক ছাড়ার সময় বিকাল ৩টি।
নিঝুম দ্বীপ
নোয়াখালীর হাতিয়া অঞ্চলে বঙ্গপসাগর ঘেরা ছোট্ট এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর। শীতের মৌসুমে পুরো নিঝুম দ্বীপ ভরে যায় অতিথি পাখিতে। এখানকার সবচেয়ে সেরা আকর্ষণ হচ্ছে চিত্রা হরিণ।
একসঙ্গে এত চিত্রা হরিণের দেখা দেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। নিঝুম দ্বীপের নামা বাজার সৈকত থেকে উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য।
সড়কপথে যে যানবাহনই ব্যবহার করা হোক না কেন, নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে প্রথমে পৌঁছতে হবে চেয়ারম্যান ঘাটে। এখানকার হাতিয়া যাওয়ার সি-ট্রাক বা ট্রলারগুলো নলচিরা ঘাটে নামিয়ে দেবে।
এবার মোটর সাইকেল দিয়ে পৌঁছতে হবে হাতিয়ার অন্য প্রান্ত মোক্তারিয়া ঘাটে। সেখান থেকে ট্রলারে চড়ে নিঝুম দ্বীপ। তবে সবচেয়ে সেরা উপায় হচ্ছে ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়ার লঞ্চে উঠে পড়া। হাতিয়ায় পৌঁছার পর তমুরদ্দী ঘাট থেকে পাওয়া যাবে সরাসরি নিঝুম দ্বীপের ট্রলার।
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা অবস্থিত সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৮২ সালে।
এটি প্রায় ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রায় ৬২ প্রজাতির প্রাণী এবং প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখির আবাস। এই অভয়ারণ্যে আছে অপরূপ সুন্দর ৩টি ট্রেইল, গোটা বনকে এক নজরে দেখার জন্য আছে সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছে টমটমে চড়ে যেতে হবে নতুন ব্রিজ। সেখান থেকে সিএনজিতে চুনারুঘাট মধ্যবাজার পৌঁছে আরেকটি সিএনজিতে করে কালেঙ্গা বাজার নামতে হবে। তারপর ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই অভয়ারণ্যের প্রধান ফটক।
মালনীছড়া চা-বাগান
উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা-বাগান সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান। ১৮৪৯ সালে লর্ড হার্ডসনের তত্ত্বাবধানে এক হাজার ৫০০ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় এই চা বাগান।
বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে থাকলেও চা বাগানপ্রিয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ পছন্দের একটি জায়গা হয়ে উঠেছে। কতৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ানো যায় বাগানে।
বাস, ট্রেন অথবা বিমান- এই ৩ রুটের যে কোনোটি ব্যবহার করে ঢাকা থেকে প্রথমে আসতে হবে সিলেটে। এরপর শহরের যেকোনো জায়গা থেকে রিকশা কিংবা সিএনজিতে চড়ে সহজেই যাওয়া যাবে মালনীছড়া চা-বাগানে।
শীতকালে বাংলাদেশ ভ্রমণের জনপ্রিয় এই ১০টি স্থান হিম শীতল প্রকৃতি দারুণভাবে উপভোগ্য করে তোলে বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। তবে এই আনন্দ ফিঁকে হয়ে যেতে পারে যদি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা না হয়।
এসময় যাত্রা শুরুর সময় অবশ্যই সঙ্গে গরম কাপড় নিয়ে নেওয়া আবশ্যক। এছাড়া ওষুধপত্রের সঙ্গে ডেটল, স্যাভলন, ব্যান্ডেজ ও তুলার মতো কিছু ফার্স্ট এইড সামগ্রিক সঙ্গে রাখা উচিত। একটি সুপরিকল্পিত পূর্বপ্রস্তুতিই পারে একটি ভ্রমণকে নিরাপদ করে তুলতে।