ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রানীনগর গ্রাম। সমাজ ভাঙ্গা গড়া নিয়ে গ্রামটির প্রায় দুই’শ পুরুষ সদস্য প্রায় ৪ মাস ধরে বাড়ি ছাড়া হলেও সমস্যা সমাধানের কোন প্রশাসনিক উদ্যোগ নেই। ফলে তাদের মাঠের আবাদঘাট ও ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট করা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, দলাদলীর কারণে সিদ্দিক হোসেন মোল্লা, ইয়ারুচ শেখ, আবু বকর, মহিউদ্দীন, তোফাজ্জেল হোসেন, হাফিজ উদ্দীন, মনজুর হোসেন, আনোয়ার, আমিরুল বিশ্বাস, আক্তানুর, মনিরুল ও মতলেব বিশ্বাসসহ গ্রামের শতাধীক কৃষকের কলার ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। তাদের প্রায় চার হাজার কলা গাছ কেটে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। জামিরুল মোল্লা নামে এক ব্যক্তির পা ভেঙ্গে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। শামীম রেজা নামে এক ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর কয়েক কিলোমিটার লাইন কেটে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় দুই লাখের বেশি টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রানীনগর গ্রামে এখন ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। বাড়ি ছাড়ার কারণে রানীনগর গ্রামের আব্দুর রশিদ মোল্লার তিন বিঘা জমির শিম ক্ষেত কেটে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি ও বাড়িতে থাকা নারী শিশুদের উপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার ভয়ে থানায় মামলা পর্যন্ত করতে ভয় পাচ্ছেন গৃহহারা পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। গৃহহীনরা বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের মারধর করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক বাড়ির উঠানে ঘাস জন্মে গেছে। রানীনগর গ্রামের শফি জোয়ারদার, আব্দুল মজিদ, জাহিদুল ইসলাম, আক্কাচ মোল্লা, আনজের মন্ডল ও বাবু জোয়াদারের নেতৃত্বে সামাজিক দলের সদস্যরা গ্রামটিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গ্রামবাসির ভাষ্যমতে শফিকুল জোয়ারদারের কুটকৌশলে পড়ে গ্রামের মানুষ সামাজিক দল নামের এক ভিলেজ পলিটিক্সে জড়িয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জানা গেছে রানীনগর গ্রামে একটি বৃহৎ সামাজিক দল ছিল। গত ৪/৫ মাস আগে এই দল ভেঙ্গে যায়। ওই গ্রামের আক্কাচ মোল্লা ও সিদ্দিক মোল্লা একই গোষ্ঠির চাচাতো ভাই হিসেবে এক সঙ্গে সামাজিক দল করতেন। কিন্তু স্বার্থগত কারণে সিদ্দিক মোল্লার সঙ্গে ভাই আক্কাচ মোল্লার বনিবনা না হওয়ায় সামাজিক দল ভেঙ্গে যায়। শরীকের দুই ভাই এখন দুইটি সামাজিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে গ্রামবাসি জানান। রানীনগর গ্রামের ইয়ারুচ শেখ জানান, ৪/৫ মাস আগে দলাদলীর ভয়াবহ চিত্র নিয়ে একটি বেসরকারী টিভিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দুই পক্ষকে থানায় ডেকে মিমাংশা করে দেওয়া হয়। কিন্তু দুই দিনও তা টেকেনি। তারপর থেকে এ পর্যন্ত তাদের উপর জুলুম নির্যাতন করা হচ্ছে। বিনা কারণে আক্তানুর মোল্লা, তোফাজ্জেল মোল্লা, ফারুক, আব্দুল গণি, মনিরুল ও নওশের আলীসহ ২০ জনের বাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। মেরে আহত করা হয় নুরুদ্দীন, বকুল, মতবেল, আব্দুর রশিদ, বকুল, সহিদা ও তরুন মোল্লাসহ ২৫ জনকে। প্রায় দুই শতাধীক কৃষক পরিবারের মাঠঘাট সব বন্ধ। কোন বাজার ঘাটে যেতে পারেন না। যারা বাড়ি আছেন তরাও অবরুদ্ধ। গভীর রাতে বাড়িতে ঢিল ছুড়ে নানা আওয়াজ করে ভয় ভীতি দেখানো হয় যা সভ্য সমাজে চলতে পারে না। সামাজিক দলের এক গ্রপের নেতা আক্কাচ মোল্লা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, একটি জমি কেনাবেচা নিয়ে তাকে দোষারোপ করে তার ভাই সিদ্দিক মোল্লা তাকে বয়কট করেন। ফলে তিনি একা হয়ে যান এবং বিরোধী গ্রপে যোগ দিলে সেই সামাজিক দলটি গ্রামে বড় হয়ে যায়। এ কারণে সিদ্দিক মোল্লার সামাজিক দলের সদস্যরা এক রকম ভয়ে বাড়ি ছেড়েছেন বলে তার ধারণা। তিনি বলেন, কাউকে অত্যাচার নির্যাতন ও বাড়ি ছাড়া করা হয়নি। তাছাড়া কোন ব্যাক্তির কলার ক্ষেত বিনষ্ট করা হয়নি বলেও আক্কাচ মোল্লা দাবী করেন।
অন্যদিকে সিদ্দিক মোল্লা বলেন, গ্রামের প্রায় দুই’শ পুরুষ সদস্য ৪/৫ মাস বাড়ি যেতে পারেন না। বাড়িতে মহিলাদের মানসিক ভাবে নির্যাতন ও হুমকী দেওয়া হয়। তিনি নিজেও শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ বাজারে থাকেন। তার মতো অনেকেই বাড়ি ভাড়া করে ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে রাত কাটাচ্ছেন। স্কুল কালেজে পুড়য়া বহু শিক্ষার্থী বাড়ি যেতে পারছেন না। তাদের পড়ালেখা বন্ধ। দুইটি ঈদ অমানবিক ভাবে কেটেছে পথে পথে। অনেক চাকরীজীবী গ্রাম ছাড়ার তালিকায় রয়েছেন। পথে পথে তাদের জীবন কাটছে। ফাঁকা বাড়িতে নারী ও শিশুরা ধার দেনা করে সংসার চালাচ্ছেন। গ্রামে এক বিভিষিকাময় পরিবেশ বিরাজ করছে বলে সিদ্দিক মোল্লা অভিযোগ করেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বর শফিকুল ইসলাম শফি খবরের সত্যতা স্বীকার করে জানান, রানীনগর গ্রামে দুইট সামাজিক দলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মোল্লা, শেখ, বিশ্বাস ও মন্ডলসহ পাঁচটি গোষ্ঠির দুই শতাধীক মানুষ বাড়ি ছাড়া। যা এই সভ্য সমাজে মোটেও কাম্য হতে পারে না। তিনি দাবী করেন, আওয়ামীলীগ সমর্থিত পরিবারের সদস্যরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ এবং বাড়ি ছাড়া হয়েছে। শফি জোয়ারদার তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কোন গ্রপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না। আগামীতে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করবেন বলে মনস্থির করেছেন। দুই পক্ষ তার কাছে ভালো। তিনি বলেন যারা বাড়ি ছেড়েছেন তারা নিশ্চয় কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছেন, তা নাহলে তারা কেন বাড়ি ছেড়েছেন?
এ বিষয়ে শৈলকুপা থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম জানান, প্রায় ৬ মাস আগে এ নিয়ে মিমাংশা করে দেওয়া হয়। কিন্তু এ ঘটনা নিয়ে আর কি হয়েছে বা এখন কি হচ্ছে তা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তিনি বলেন, কেউ বাড়ি ছাড়া বা ক্ষেতের ফসল কাটলে তো অভিযোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু কেউ তো অভিযোগ দেয়নি। তিনি জনান, কেউ বাড়ি যেতে না পারলে দ্রতই তাদের বাড়ি তুলে দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হবে।
আহসানুজ্জামান সোহেল/অননিউজ24