একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করে স্থানীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া সিন্ডিকেট চক্রের হাতে জিম্মি কুড়িগ্রাম সদর সমাজসেবা অফিস। টাকা ছাড়া মেলে না শিক্ষা উপবৃত্তি,অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরদের উপবৃত্তির টাকা। আর এসব অনিয়ম বাইরে প্রকাশ না হয় সেজন্য ইউনিয়ন সমাজকর্মীদেরকে দেয়া হয় না ট্যাবের পাসওয়ার্ড।
অনুসন্ধানে দেখাযায়,কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে কর্মকর্তাসহ কতিপয় কর্মচারীরা অবস্থান করছে। আর এই সুযোগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশদের নিয়ে গড়ে ওঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। এই সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সদর উপজেলার প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তি,অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরদের উপবৃত্তি তালিকা। সিন্ডিকেট চক্রকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তালিকায় নাম না থাকার পরও টাকা পাওয়া যায়। অথচ তালিকায় নাম থাকার পরও সিন্ডিকেট চক্রকে উৎকোচ বা সন্তুষ্ট করতে না পারলে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এমনটি ঘটেছে সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের দুবাআছরি গ্রামের একাদশ শ্রেণী পড়ুয়া শ্রীমতি মনিকা বালা ও৷ সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী গোলাপি রাণীর বেলায়। সমাজসেবার অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া শিক্ষা উপবৃত্তির তালিকায় উপকারভোগী ৮৪৯০০০০৩৬০ নং এ নাম রয়েছে মনিকা বালার। সেখানে তার পিতা মনোরঞ্জন,মাতা-রুপালি রাণী এবং গ্রাম-দুবাআছরি দেয়া আছে। সব ঠিক থাকলেও ঠিক নেই শুধু মোবাইল নাম্বারটি। মনিকা বালার তালিকায় যোগাযোগ নাম্বার দেয়া আছে ৫৭৪০ অথচ টাকা যাচ্ছে ৪৭৮৯ নাম্বারে। এমন অবস্থা একই এলাকার সপ্তম শ্রেণীর গোলাপী রাণীরও। উপকারভোগী তালিকায় ৮৪৯০০০০৩৫৯নং এ পিতা-গোপাল চন্দ্র সেন, মাতা-শ্রীমতি শেফালী রাণী। মোবাইল নাম্বার হিসেবে দেয়া আছে ৬৯৪১নং। কিন্তু টাকা যাচ্ছে ১০৪৮ নং এ। উপকারভোগী তালিকায় নাম, ঠিকানা,মোবাইল নাম্বার থাকলেও তারা কোন শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছে না। এমন অনেক উপকারভোগী তালিকাতে নাম থাকার পরও টাকা পাচ্ছে না। আবার তালিকায় নাম নেই অথচ নিয়মিত তারা টাকা পাচ্ছেন। আবার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত অনেকেই বেশ কয়েক বার টাকা পেলেও হঠাৎ করে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে এসব পরিবার গুলো কোন টাকা না পাওয়ার অভিযোগ করেন পরিবার গুলো।
এই বিষয়ে শ্রীমতি মনিকা বালা বলেন, আমি তো আবেদনই করি নাই। অথচ অনগ্রসর শিক্ষা উপবৃত্তির তালিকায় আমার নাম,বাবা-মায়ের নামসহ যোগাযোগের জন্য মোবাইল নাম্বারটি ঠিক আছে। শুধু টাকা যাওয়া মোবাইল নাম্বারটি আমাদের নয়। আমি একাদশ শ্রেণীতে পড়ছি। এই দশ বছরে আমি এক টাকাও উপবৃত্তি পাইনি।
গোলাপী রাণির মা শ্রীমতি শেফালী রাণী বলেন, তালিকায় যে নাম ঠিকানা আছে তার সবই মিল আছে। কিন্তু যে মোবাইল নাম্বারে উপবৃত্তির টাকা যায় তা আমাদের নয়। আমার মেয়ে কোন সমাজসেবার উপবৃত্তির টাকা পায় না।
অনুকুল চন্দ্র সেনের মা শ্রীমতি রত্না রাণী বলেন, তালিকায় ৮৪৯০০০০৩৫৮নং এ আমার ছেলের নাম রয়েছে। আগে টাকা পেয়েছি। কিন্তু দু’বছর ধরে টাকা পাই না। অফিসে গিয়ে কাজ হয়নি। আমাদের ৪৬৪০নং মোবাইল নাম্বারের পরিবর্তে টাকা যাচ্ছে ৯১৫৭ নং মোবাইল নাম্বারে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমাদের পাশের গ্রাম গড়ের পাড়ে একজন পাচ্ছেন। অথচ তালিকায় তাদের নাম নেই।
একই অবস্থা তালিকার ৮৪৯০০০০৩৬৭নং সঞ্জয় কুমারেরও। সঞ্জয়ের বাবা নিপু চন্দ্র জানান,আমার ছেলে প্রায় তিন বছর ধরে কোন টাকা পাচ্ছে না। তালিকাতে আমাদের নাম,ঠিকানাসব ঠিক থাকলে অন্য নাম্বারে টাকা দিচ্ছে। কিভাবে তালিকায় নাম না থাকারও পরও টাকা পাচ্ছে সেটা আমরা বলতে পারি না। অফিসের কারসাজির জন্য আমরা গরিব মানুষ সরকারের এমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
গড়ের পাড় বাসিন্দা শাহানাজ বেগম বলেন,অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরদের উপবৃত্তির তালিকায় নাম নেই। কিন্তু ঘোগাদহ ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার শংকরকে দুই সন্তানের জন্য কয়েক দফায় প্রায় ১০হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর থেকে এক সন্তানের জন্য উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছি। আরেক একজনের হয়নি এখনো।
একই এলাকার বাসিন্দা মালতি রাণী বলেন,আমরা তো অফিসের ব্যাপার সেপার বুঝি না। তাই সাবেক মেম্বার শংকরকে তিন হাজার টাকা দিয়ে সন্তানের জন্য উপবৃত্তির টাকা নিচ্ছি। সে কিভাবে করে দিছে সেই ভালো বলতে পারবে।
অভিযুক্ত সাবেক শংকর মেম্বার টাকা নেবার কথা স্বীকার করে বলেন, অফিস খরচের জন্য কিছু টাকা নেয়া হয়েছে। উপবৃত্তির তালিকা থেকে মোবাইল নাম্বার পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।
শুধু শিক্ষা উপবৃত্তিতে নয়। অনিয়ম রয়েছে ভিক্ষুক পুর্নবাসন তালিকা নিয়েও। ভিক্ষুক নয় এমন পরিবারকে ভিক্ষুক দেখিয়ে নামমাত্র ছাগল দেয়া হয়েছে। সেখানেও শুভংকরের ফাঁকি। ঘোগাদহ ইউনিয়নের গরীব অসহায় পরিবারটির জন্য ২৫হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও দেয়া হয়েছে দুটি ছাগল আর একটি ঘরসহ দু’হাজার টাকা নগদ।
সুবিধাভোগী আফরোজা বেগম বলেন,আমার স্বামী ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন আগে মারা গেছে। তার চিকিৎসার পিছনে জমিজমা সব শেষ। আমরা কোন ভিক্ষুক নই। জুন মাসে সমাজসেবা অফিস থেকে দুটি ছাগলের বাচ্চা এবং একটি ছোট ঘর দিয়েছে। আর নগদ টাকা দিয়েছে দু হাজার টাকা। আমরা ২৫হাজার টাকা পাইনি। তবে ছাগল দুটির আনুমানিক মূল্য ৬/৭হাজার টাকা হবে আর নগদ যে টাকা দিয়েছে তা মিলে ১০হাজার টাকা হবে।
যাত্রাপুর ইউনিয়ন সমাজকর্মী শাহিনুর বেগম বলেন, সরকারি ভাবে আমরা একটি করে ট্যাব পেয়েছি। কিন্তু সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা পাসওয়ার্ড না দেয়ায় এখন সেগুলো সন্তানদের খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাসওয়ার্ড না থাকায় সদর উপজেলার ইউনিয়ন সমাজকর্মী কেউই সেগুলো ব্যবহার করতে পারছি না।
কাঁঠালবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রেদওয়ানুল হক দুলাল বলেন,সমাজসেবা কল্যাণ পরিষদ,সিএসপি প্রজেক্ট, প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তি,অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির শিক্ষা উপবৃত্তির সুবিধাভোগীদের তালিকা সম্পর্কে আমি জানি না। কিভাবে সমাজসেবা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছে তা তারাই ভালো জানে।
সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এসএম হাবিবুর রহমান শিক্ষা উপবৃত্তি না পাওয়া প্রসঙ্গে সুবিধাভোগীদের উপর দায় চাপিয়ে বলেন,তারা প্রতিবন্ধি ভাতা নিতে ইচ্ছুক। প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তি নিতে চায় না কারণ এটা সাময়িক। আর ট্যাবের পাসওয়ার্ড বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক স্টাফ আছে বয়স হয়েছে,এই বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় পাসওয়ার্ডের জটিলতা রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানাযায়, প্রতিমাসে-৫০০টাকা হারে অনগ্রসর জনগোষ্ঠি উপবৃত্তি ৯২জন এবং প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তি ৪৪জন পাচ্ছেন। এরমধ্যে প্রতিবন্ধি শিক্ষা উপবৃত্তি প্রাথমিক স্তর ৯০০টাকা, মাধ্যমিক স্তর-৯৫০টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর-১০০০টাকা এবং উচ্চতর স্তর-১২০০টাকা করে সরকার প্রদান করে আসছে।
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবার উপপরিচালক মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন,আমি ইতোমধ্যে সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় পরিদর্শন করেছি। নানা অনিয়মের বিষয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তিন কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিবেন। এরপর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবা।