সোনাগাজীতে পানির জন্য কৃষকদের স্বপ্ন ফেটে চৌচির, বরো চাষ করে হাজার হাজার কৃষক উদ্বিগ্ন
জাবেদ হোসাইন মামুন, সোনাগাজী (ফেনী)
ফেনীর সোনাগাজীতে পানির জন্য কৃষকদের স্বপ্ন ফেটে যেন চৌচির হয়ে গেছে। বরো চাষ করে পানির সংকটে হাজার হাজার কৃষক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কৃষি বিভাগের আশ্বাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বরো ধানের চারা রোপন করে খালে পানি না থাকায় ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্পও কৃষকদের কোন কাজে আসছেনা। উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা জুড়ে ৫০টিরও বেশি খাল রয়েছে। মুহুরী নদীতে মিঠা পানি, বড় ও ছোট ফেনী নদীতে নোনা পানি থাকলেও রহস্যজনক কারণে খালগুলোতে পানি যাচ্ছেনা। নদীগুলোর মোহনায় খালে পানি ধরে রাখার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি রেগুলেটর (গতি নিয়ন্ত্রক)।
গত কয়েক বছর যাবৎ শত শত কোটি টাকার সরকারি খরচে খালগুলো সংস্কারও করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরও খালগুলো পানি থাকছেনা। পানি পাওয়া জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে লিখিত আবেদন করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেননা কৃষকরা। ইতোমধ্যে কৃষকদের পক্ষ থেকে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিক লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। সকল দপ্তরের কর্মকর্তারা খালে পানি সরবরাহ করার আশ্বাস দিলেও খালগুলোতে এখনো পানি সরবরাহ করতে পারেননি। অধিকাংশ এলাকায় সবুজ ধানে আকৃষ্ট হয়ে গ্রামের পুকুরগুলো থেকে পানি কিনে জমিতে সেচ দিয়েছেন। অনেক পুকুরের পানি পুরিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের স্বপ্নের ধান নিয়ে উদ্বিগ্নতা আরো বেড়ে গেছে। কেউ কেউ স্বর্ন বন্ধক রেখে, ব্যাংক, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এক বুক আশা নিয়ে বরো আবাদ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বর্গা চাষীরা সবব চেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে জানা গেছে। ভিটি-বাড়ি বন্ধক রেখেও কেউ কেউ বরো আবাদে নেমেছিলেন। সব হারিয়ে নি:স্বহ হওয়ার আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ। এবার সরকারি হিসাব মতে সোনাগাজী উপজেলায় বরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৩০০ হেক্টর। সে ক্ষেত্রে চাষ হয়েছে এক হাজার ৮০০ হেক্টর। এর মধ্যে উচ্চফলনশীল (উফশী) এক হাজার ৫০০হেক্টর ও হাইব্রিড চাষ হয়েছে ৩০০ হেক্টর। বেসরকারি হিসাব মতে সোনাগাজীতে বরো আবাদ হয়েছে প্রায় তিন হাজার হেক্টর।
চাষকৃত ধাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিআর-১৬, ব্রিধান-২৮, ২৯, ৬৭, ৬৮,৭৪, ৮৮, ৮৯, ৯২, বিনা-১০, ২৪, হাইব্রিড ব্র্যাক-১১, রূপালী, দোয়েল, সম্পদ, হীরা-২, ময়না, টিয়া। এ উপজেলায় রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। বিজ্ঞানীরা ধানের নতুন নতুন জাতও উদ্ভাবন করে যাচ্ছেন। উপকূলীয় এ উপজেলায় কৃষকদের নিরব কান্না যেন দেখার কেউ নাই। পৌর এলাকার চরগণেশ গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, পানি না দিলে আমাদেরকে জমিতে গুলি করে মেরে ফেলা হোক। নিজের ক্ষেতে বিআর-২৯ ধানের চারা লাগিয়েছেন। খালে পানি না থাকায় দূরের একটি পুকুর থেকে পানি কিনে এনে মাঠে দিয়েছেন। কিন্তু সেই পানিও শুকিয়ে গেছে। সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের চরখোয়াজ গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, বড় আশা করে দেড় একর জমিতে বরো আবাদ করেছি। এক একর নিজে আর বাকী আধা একর বর্গা চাষীকে দিয়ে চাষ করিয়েছি। পানি সংকটে আমি ও আমার বর্গা চাষীর মাথায় হাত পড়েছে। আমি মনে করেছি কৃষক বাঁচলে, দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, কিস্তু পানির এ সংকটে আমাদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।
চরচান্দিয়া ইউনিয়নের লন্ডনী পাড়ার কৃষক প্রতিনিধি মিজানুর রহমান বলেন, তিনি সহ সহযোগি কৃষকরা ব্যাংক, এনজিও, স্বর্ন বন্ধক রেখে বুক ভরা আশা নিয়ে কয়েক’শ একর জমিতে বরো আবাদ করা হয়েছে। ধানের সাথে কৃষকরা মারা যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। পানি সরবরাহের জন্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন জানিয়েও কোন প্রতিকার পাইনি। ধানক্ষেত পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। চরগণেশ গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, পাউবো কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সেচ কার্ড দিয়েছেন। পানির জন্য টাকাও রিচার্জ করেছি। পানিও পাচ্ছিনা রিচার্জকৃত টাকাও ফেরৎ পাচ্ছিনা। চরদরবেশ ইউনিয়নের চরসাহাভিকারী গ্রামের ওসমান গণি বলেন, আমাদের সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মতে এক ইঞ্চি কৃষি জমিও খালি না রাখার জন্য, অথচ আমরা আজকে নি:স্বহ হয়ে পড়েছি। সবুজ ধান ক্ষেতে পানির অভাবে জলে পুড়ে চারখার হয়ে গেল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে খালে পানি সরবরাহ করতে না পারলে ধানের চরম ক্ষতি হবে। এতে কৃষকদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হবে। এর ফলে আমাদের বরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ভেস্তে যাবে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছি। পানি সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতি পুষিয়ে আগামীতে বরো সহ অন্য ফসল চাষেও আগ্রহ হারাবেন।
সোনাগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন বলেন, কৃষকদের পানি সমস্যার কথা আমরা জেনেছি। নিয়মিত পাউবো কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে পাউবো কর্তৃপক্ষ পানি সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, পাউবোর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে কৃষকদের পানির সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছেন।
উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক, সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র অ্যাড. রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, কৃষকদের দাবির প্রেক্ষিতে আমরা পাউবো কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছি। সংশ্লিষ্টরা আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুত সময়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পানি সরবরাহ করবেন।
এ ব্যাপারে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান ভূঞা বলেন, বেশ কয়েকটি খালে মাটি ভরাট হয়ে গেছে। কৃষকদের দাবির প্রক্ষিতে পাউবোর প্রকল্প পরিচালক রাফিউজ সাজ্জাদ খালগুলো পরিদর্শণ করে গেছেন। মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পেশ করেছি। দীর্ঘ দিন বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর পানির নাব্যতাও সংকট রয়েছে। দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।