দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা হিলিতে করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘ দেড়বছরের বেশী সময় ধরে স্কুল কলেজসহ সবধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেশ সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এসময়ে উপজেলার সব স্কুল কলেজ মিলিয়ে ৫শতাধিক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা ঘটেছে। ২শতাধিক ছেলে শিক্ষার্থী কাজের সন্ধানে গার্মেন্টস রাজমিস্ত্রিসহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এখন বিদ্যালয় খুললেও উপস্থিতির হার অনেকটা কম। তবে কিছুদিন গেলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে দাবী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের।
হাকিমপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ৩টি কলেজ, ৩টি স্কুল এন্ড কলেজ, ১৮টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে, ১৩টি ফাজিল ও দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলে করোনা কালীন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ৫শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ ও ২শ ছেলে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
হিলির জালালপুর দ্বিমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিলকিছ আকতার বলেন, করোনার কারনে দীর্ঘ দিন বন্ধের পরে আবারো স্কুলে আসতে পেরেছি এজন্য আমাদের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আবার বেশ মন খারাপো হচ্ছে এর কারন হলো আমাদের অনেক বান্ধবির বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে তারা খুব ভালো ছাত্রী ছিলো আগে একসাথে আমরা ক্লাস করতাম আমাদের ভালো বন্ধু ছিলো তারা এখন স্কুলে আসেনা আমরা তাদেরকে খুব মিস করছি।পড়ালেখা শেষ না করেই তাদের বিয়ে হয়ে গেলো কেমন একটা বিষয় হয়ে গেলো। আবার তারা সকলেই স্কুলে ফিরে আসুক আমরা একসাথে লেখাপড়া শুরু করি। সেইসাথে আমরা আশা করতেছি ভবিষ্যৎে যেন এরকম না হয় সবাই যেন ভালোভাবে পড়ালেখা শেষ করতে পারে এরপরে তাদের যেন বিয়ে হয়।
একই বিদ্যালয়ের অপর ছাত্র শরিফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পরে স্কুলে আসতে পারায় ও ক্লাস করতে পারায় আমরা বেশ খুশি, আমরা আশা করছি আমাদের যে পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে সেটি কাটিয়ে উঠতে পারবো। কিন্তু আগে আমাদের অনেক বন্ধু ছিল সকলেই একসাথে ক্লাস করেছি কয়েকজন বেশ ভালো ছাত্র ছিল যাদের অনেকেই আজ স্কুলে নেই। অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ যার কারনে তারা অনেকেই আসতে পারেনি তারা গার্মেন্টসে, রাজমিস্ত্রীর কাজসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছে। এর কারনে আমরা তাদেরকে খুব মিস করছি, স্কুল খুলছে জানানো হলেও তারা আর আসছেনা।
হিলির জালালপুর দ্বিমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আশরাফুল সিদ্দিক বলেন, আগে আমাদের স্কুলে যত সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ছিলো করোনার কারনে দীর্ঘদিন বন্ধের পরে এখন স্কুল খোলার পরে অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে আসছে। দীর্ঘদিন বন্ধের কারনে অনেক ছাত্র বিভিন্ন কাজে চলে গেছে যারা আর ফিরে আসছেনা। তাদের টাকা উপার্জনের উপর একটা মায়া বা লোভ চলে এসেছে। আবার মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে বসে থাকার কারনে অনেক বাবা মনে করেছে কবে স্কুল খুলবে না খুলবে এসময়ে ভালো একটি ছেলে পেয়েছি বিয়েটা দিয়ে দেয় এরকম করে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। যার কারনে এখন অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে নেই, তবে এখন যদি নিয়মিত স্কুলে ক্লাস হয় তাহলে এই পরিস্থিতি অনেকটা কেটে উঠবে।
একই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন, করোনা মহামারির মাঝে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষাত হচ্ছে শিক্ষা খাত। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতির সন্মুক্ষিন হয়েছি আমরা গ্রামীন যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো। অনেক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে এখানে, আগে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রানচাঞ্চল্য ছিল যে পরিবেশটা আমরা তৈরি করেছিলাম সেটি অনেকাংশেই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। এখন অনেক চেষ্টা করেছি আমরা তারপরেও আর্থিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়েছে অনেক মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে যেটা কোনভাবেই কাম্য নয় বাল্যবিয়ের পক্ষে আমরা কোনদিনই ছিলামনা। মেয়েকে নিয়ে তাদের অভিভাবকরা যতটা আর্থিক ভাবনাই পড়ে তার চেয়ে বেশী ভাবনাই পড়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে। আমরা যেন প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে শহরাঞ্চল পর্যন্ত সবখানেই মেয়েদের নিরাপত্তা অত্যন্ত পাই। যুবক ছেলেদের যেখানে সেখানে আড্ডা বা এসমস্ত বিষয়গুলোকে যেন সচেতনতার মাধ্যমে রোধ করা যায় তাহলে আমি মনে করি অনেকটা ঝড়ে পড়ার হার কমে যাবে।
বাংলাহিলি পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা কামাল বলেন, অনুপস্থিত বলতে আমার স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা অত্যান্ত গরীব, করোনার কারনে দীর্ঘসময় ছুটির ফাকে তারা হয়তোবা বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। কারো দোকানপাঠে কর্মচারী হিসেবে অনেকে কাজ করছে। এমনো শিক্ষার্থী আছে তার হয়তো বাড়িতে ঠিকমতো খাবার নেই এরকম লজ্জার কারনে স্কুলে আসেনা।
বাংলাহিলি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান বলেন, যেহেতু এটা দীর্ঘ দেড় বছর ধরে গড়ে উঠা একটা অভ্যাসের ব্যাপার আবার অনেক শিক্ষার্থী হয়তোবা দুরে আছে কেউ ঢাকায় গেছে, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন জেলায় চলে গেছে। একারনেই বিদ্যালয়ে ছাত্রীর উপস্থিতি কম হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারনে তাদের যে পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবো তবে একবছরের কোর্স তো আর তিন মাসে শেষ করা যাবেনা তবে আমরা চেষ্টা করবো।
হাকিমপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বোরহান উদ্দিন বলেন, করোনার কারনে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে তারা স্কুলে আসেনি। সে থেকে আবারো স্কুলে ফেরত আসা একটু দুরুহ ব্যাপার। আস্তে আস্তে এটার অবশ্যই পরিবর্তন হবে ও ছেলে মেয়েরা অবশ্যই স্কুলে আসবে। আর আমাদের এই উপজেলাটি একটি সীমান্ত ঘেষা উপজেলা ও দরিদ্র প্রবন উপজেলা সেক্ষেত্রে যখন দীর্ঘ দেড়বছর যাবৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সেক্ষেত্রে বিশেষ করে ছাত্রীরা অনেকে গার্মেন্টসের চাকুরির দিকে ঝুকে পড়েছে আবার অনেকের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে মেয়েরা হয়তোবা সব ফেরত আসবেনা যেহেতু তারা চাকুরিতে যাওয়ার কারনে আর্থিক সহযোগীতা পাচ্ছে। যেহেতু স্কুল খোলা হয়েছে সেহেতু অনেকে স্কুলে ফেরত আসতে পারে তবে দেড় বছর ধরে স্কুলে না আসার প্রবনতা কাটতে একটু সময় লাগবে।
সাইফুল ইসলাম সুমন,অননিউজ24।।