রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশ ডেকেছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে সমাবেশের কাজ চলছিল। সমাবেশের শেষ পর্যায়ে দলটির সভানেত্রী ও তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখছিলেন। তার বক্তব্য যখন প্রায় শেষ ঠিক তখনই শুরু হয় একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ। ওই ঘটনায় সেদিন ঘটনাস্থলে ও পরে আহতদের মধ্যে দুজনসহ মোট নিহত হয়েছিল ২৪ জন। যদিও এর মধ্যে দুজনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের অনেকেসহ প্রায় তিনশ’ মানুষ আহত হন। যাদের পরে দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। এখনো পঙ্গু হয়ে আছেন অনেকে।
প্রাণ হারিয়েছেন যারা
আইভি রহমান: সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান স্ত্রী আইভি রহমান, ছিলেন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক। সমাবেশের মঞ্চের সামনেই রাস্তায় কর্মীদের নিয়ে বসেছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলায় তার পা উড়ে যায়। দুদিন পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার পুরো নাম বেগম জেবুন্নেছা আইভি।
১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব শহরের চন্ডিবের গ্রামে তার জন্ম হয়। বাবার নাম জালাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। মা হাসিনা বেগম ছিলেন গৃহিণী। আট বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আইভি রহমান পঞ্চম ছিলেন।
মোস্তাক আহমেদ সেন্টু: আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সহ সম্পাদক ছিলেন মোস্তাক আহমেদ সেন্টু। বরিশাল পলিটেকনিকের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় ছাত্রলীগের সাথে জড়িত হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। গ্রেনেড হামলার সময় শেখ হাসিনাকে ঘিরে যারা মানব ঢাল তৈরি করেছিল তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। ওই অবস্থাতেই অসংখ্য স্প্লিনটার বিদ্ধ হয় তার শরীরে। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ: শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দলের সদস্য ছিলেন। গ্রেনেড হামলার পর শেখ হাসিনাকে যখন দলীয় নেতাকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীরা তার গাড়িতে তুলে দিচ্ছিলেন তখন শেখ হাসিনাকে আড়াল করে রাখা এই নিরাপত্তারক্ষী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
রফিকুল ইসলাম: আদা চাচা নামে আওয়ামী লীগের কর্মী মহল ও আওয়ামী লীগের খবরাখবর সংগ্রহ করতো এমন গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন রফিকুল ইসলাম। আনুষ্ঠানিক পদবী ছিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ষাটের দশক থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মসূচিতে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। তিনি সাধারণ গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে অবস্থান করতেন এবং সাংবাদিকদের মধ্যে শুকনো আদা বিতরণ করতেন নিজের উদ্যোগে। গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও সাংবাদিকদের কাছেই ছিলেন তিনি।
সুফিয়া বেগম: ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন সুফিয়া বেগম। ধারণা করা হয় তিনি শেখ হাসিনার মঞ্চের সামনে আইভি রহমানের কাছাকাছি ছিলেন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছিল তার।
হাসিনা মমতাজ রীনা: ঢাকার ১৫নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। তিনিও আইভি রহমানের সাথে মঞ্চের সামনেই ছিলেন অন্য নারী নেতাকর্মীদের সাথে।
লিটন মুন্সী ওরফে লিটু: মাদারীপুরে যুবলীগের রাজনীতি করতেন লিটন মুন্সী। সেখানে একটি ইউনিয়ন শাখা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। ঢাকায় আসলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ে নিয়মিত আসতেন এবং দলীয় কর্মসূচিতেও অংশ নিতেন। একুশে অগাস্টের কর্মসূচিতে যুবলীগের অন্য নেতাকর্মীদের সাথেই ছিলেন তিনি। গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।
রতন সিকদার: রতন সিকদার ছিলেন পেশায় রি-রোলিং মিল ব্যবসায়ী। নারায়ণগঞ্জের উত্তর মাসদাইর এলাকার এই ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণের সময় মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়েই সভানেত্রীর ভাষণ শুনছিলেন তিনি।
মো: হানিফ: ঢাকার ত্রিশ নম্বর ওয়ার্ডের রিকশা শ্রমিক লীগের নেতা ছিলেন তিনি। দলীয় মহলে পরিচিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হানিফ নামে।
মামুন মৃধা: সরকারি কবি নজরুল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন মামুন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।
বেলাল হোসেন: ঢাকার ৬৯নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পুরনো ঢাকার আগামসিহ লেনের বাসিন্দা বেলাল হোসেন মিছিলসহ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এসেছিলেন শেখ হাসিনার সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্য। ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম: যুবলীগের কর্মী ছিলেন। সমাবেশে যোগ দিতে তার এলাকা থেকে আসা মিছিলের সাথে ছিলেন তিনি।
আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী: তিনি ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী।
আতিক সরদার: যুবলীগের ৮৪ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা ছিলেন তিনি।
নাসিরউদ্দিন সরদার: আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের কর্মী ছিলেন।
রেজিয়া বেগম: স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেত্রী। একই সাথে মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতেও নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি।
আবুল কালাম আজাদ: ঢাকার বালুঘাট ইউনিট যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। এছাড়া সংগঠনের ১৫ নং ওয়ার্ড শাখার কার্যকরী সদস্য ছিলেন।
এছাড়া ইছহাক মিয়া, শামসুদ্দিন, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী ও মমিন আলী ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী। গ্রেনেড হামলার পর ঘটনাস্থলে বা হাসপাতালে নেয়ার সময় কিংবা হাসপাতালে নেয়ার পর তারা মৃত্যুবরণ করেন।
অজ্ঞাত দু জন: উপরে যাদের নাম রয়েছে তারা ছাড়াও আরও দুজন মারা যান গ্রেনেড হামলায়। কিন্তু পরে তাদের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে তালিকায় তাদের নাম অজ্ঞাত হিসেবেই রয়েছে।
এফআর/অননিউজ