সোনাগাজীতে তরমুজ চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা, বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে
জাবেদ হোসাইন মামুন, সোনাগাজী (ফেনী)।।
ফেনীর সোনাগাজীতে তরমুজ চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। গ্রীস্মকালীণ মিষ্টি ও রসালো ফলটি শুধু সোনাগাজীর মানুষ নয় সমগ্র দেশবাসীর কাছে অতি প্রিয় সুস্বাদু একটি ফল। গ্রীস্মের প্রচন্ড তাপদাহে ধর্মপ্রাণ রোজাদার মুসল্লীদের ইফতারে রসালো এই ফলটি পুষ্ঠির যোগানের সাথে সাথে আরামদায়ক কোমল পানির শরবত হিসেবেও যোগান দিচ্ছে। সারা দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে সোনাগাজীর তরমুজ। বিগত বছরের তুলনায় এবার ফলন বেশী হলেও ভোক্তাদের অতিরিক্ত দাম গুণতে হচ্ছে।
তিন দিকে নদী বেষ্ঠিত এই উপকূলীয় উপজেলার দুটি ইনিয়নের চরাঞ্চলে গত চার বছর ধরে চাষ হলেও এবার আরো দুটি ইউনিয়নের চরাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়েছে তরমুজ। গরু-মহিষ ও ভেড়ার চারণভূমিগুলোতে এখন সবুজ তরমুজের সামরোহ। প্রতিদিন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চাষকৃত জমিতে কৃষকের সাথে হাসিমাখা ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট দিচ্ছেন শতশত মানুষ। কেউবা কমদামে কেনার আশায় ক্ষেতে গিয়ে হতাশ হয়ে খালি হাতে ফিরছেন আবার কেউ কেউ চড়া দামে কিনে নিচ্ছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস, এলাকাবাসী ও স্থানীয় কৃষকরা জানায়, ২০১৭ সালে নোয়াখালীর সুবর্ণচর থেকে আগত কৃষক আবুল কাসেম ও জামাল উদ্দিন পরীক্ষামূলকভাবে চরচন্দিয়া ও চরদরবেশ ইউনিয়নের চরাঞ্চলে তরমুজ চাষ করেন। ওই বছরে তাদের সফলতা দেখে ২০১৯ সালে আরো ১৫-২০ জন কৃষক তাদের জমিতে রবি মৌসুমে তরমুজ চাষ করেন এবং তারা সকলেই আর্থিকভাবে লাভবান হন।
বেশি ফলন ও ভালো দাম পেয়ে তরমুজ চাষীরা ২০২০ সালে উপকূলীয় এলাকায় দুটি ইউনিয়নের ১৫০ হেক্টর চরের জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেন। তাদের লাভজনক চাষে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ২০২১ সালে ৩১৭ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়। চলতি মৌসুমে উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ ও পশ্চিম চরদরবেশ মৌজায়, চরচান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ পূর্ব চরচান্দিয়া ও পূর্ব বড়ধলী মৌজায়, আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরসোনাপুর মৌজায় এবং সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের চরশাহাপুর ও মুক্তার চরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভিক্টর সুগার, ওশেন সুগার ব্লাক বেরি, বাংলা লিংক ও দেশীয় জাতের ৩৪৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। চরদরবেশ ইউনিয়নের দুটি মৌজায় চাষকৃত তরমুজ বিক্রি প্রায় শেষ পর্যায়ে। চরচান্দিয়া, সোনাগাজী সদর ও আমিরাবাদের তরমুজ বিক্রি চলছে পুরোদমে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মৌসুমী ফলব্যবসায়ীরা ক্ষেত থেকে বড় বড় ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান যোগে তরমুজ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব তরমুজ ঢাকা-চট্রগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।
সরেজমিনে দেখা যায়, নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ থেকে তরমুজ চাষ করতে আসা কৃষকরা ক্ষেতের মাঝেই ‘টংঘর’ স্থাপন করে থাকা-খাওয়া আর বিশ্রাম করছেন। রৌদ্রের উত্তাপ এড়িয়ে কৃষকরা এখন তরমুজ ক্ষেতে আগাছা ও পোকা দমনে ব্যস্ত সময় পার করছে। কেউ কেউ উম্মুক্ত চরে গরু, মহিষ ও ভেড়ার উৎপাতে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।
চরদরবেশ ইউনিয়নের দেলোয়ার হোসেন নামে এক কৃষক জানান, নোয়াখালীর চাষীদের দেখে স্থানীয়রাও গত দুই বছর তরমুজ চাষাবাদ করেছেন। অল্প সময়ে অধিক লাভবান হওয়ায় কৃষকরা তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন। তিনি আরো সরকারের সার্বিক সুবিধার পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা বা লোন সুবিধা পেলে কৃষকের আগ্রহ আরো বাড়বে বলে জানান।
তরমুজ চাষী আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি স্থানীয়দের থেকে ৫ মাসের জন্য প্রায় ৫০ একর জমি সাত মাসের জন্য ইজারা নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন। প্রতি একরে উৎপাদন ও পরিচর্যা ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা।
প্রতি একরে ফলন থেকে তিনি দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে প্রত্যাশা তার। তিনি জানান, তরমুজ চাষে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কম সময়ে লাভসহ চালান ফেরত আসে। তাই তিনি প্রতিবছর স্থানীয়দের থেকে জমি লিজ নিয়ে তরমুজ চাষ করে আসছেন। তরমুজ বিক্রি শেষে তিনি আবার নিজ এলাকায় চলে যাবেন।
তরমুজ চাষী আইয়ূব আলী জানান, ১৫ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। এখানে উৎপাদিত তরমুজের আকার, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ভালো থাকায় কম সময়ে পাইকারদের আকৃষ্ট করা গেছে। তাছাড়া গত বছর সোনাগাজী-কোম্পানীগঞ্জ সড়কে সাহেবের হাট সেতু উদ্বোধনের পর নোয়াখালী ও ফেনীতে যাতায়াত সুবিধা সৃষ্টি হয়। এর ফলে সোনাগাজীর চরাঞ্চলে উৎপাদিত ফসলের বাজারজাত সহজ হয়ে ওঠায় পাইকারি ক্রেতাদের কাছে এখানকার তরমুজের চাহিদা বেড়ে গেছে। সড়ক ব্যবস্থার উন্নতির ফলে সোনাগাজী হতে সংগৃহীত তরমুজ সহজেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয়া যায়।
এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার জানান, চরাঞ্চলে তরমুজের ফলন ভালো হওয়ায় দিন দিন আবাদ বাড়ছে। চলতি মৌসুমে উপজেলার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় আগামীতে আরো বেশি তরমুজ আবাদের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তিনি আরো জানান, এবার সোনাগাজীতে ব্লাক জায়ান্ট, গেলারি, সুগার বেবি, ট্রপিক্যাল ড্রাগন, বাংলা লিংক ও ভিক্টর সুগার জাতের তরমুজ বেশি চাষ হয়েছে। নিয়মিত তরমুজ ক্ষেত পরিদর্শন করে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আবাদ ও ফলন বাড়াতে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পরিদর্শন ও পরামর্শদানসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় কৃষকদের আবাদে উৎসাহিত করতে তরমুজ চাষের প্রদর্শনী দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১০টি তরমুজ চাষের প্রদর্শনী দেয়া হয়েছে। আশা করি প্রদর্শনীর উৎপাদন ও লাভ দেখে কৃষকরা আরো উদ্বুদ্ধ হবেন। এবার কৃষকরা দামও ভালো পাচ্ছেন।