কুড়িগ্রাম এলজিইডিতে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় দিনমজুরের মৃত্যু, জীবনের মূল্য ৩ লাখ টাকা

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

কুড়িগ্রামে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কার্যালয়ের প্রকৌশলীর অবহেলার কারণে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এক দিনমজুর।ভুয়া পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি,মৃত্যুর পরে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে দরকষাকষির মাধ্যমে ওই শ্রমিকের জীবনের মূল্য নির্ধারণ করা হয় তিন লাখ টাকায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার।নাম প্রকাশ না করার শর্তে অত্র অফিসের এক কর্মচারী জানান এ ঘটনায় সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুজ্জামান ও সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হাসান আলী ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে প্রায় ১০/১২ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন, অথচ মৃতের পরিবার পেলো মাত্র ৩ লাখ টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম এলজিইডি কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হাসান আলী এলজিইডি অফিসের গাছের ডাল কাটার জন্য রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের মহিধর খন্ডক্ষেত্র গ্রামের চকিদার পাড়ার শাহাবুদ্দিন ওরফে রহিম বকস (৭০) এবং যুবরাজ (৫৬) নামের দুই ব্যক্তিকে দিনমজুর হিসেবে ঠিক করেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি/২৫ শনিবার অফিস বন্ধ থাকায় তাদের দিয়ে গাছের ডাল কাটার কাজ করান ওই প্রকৌশলী।

সেদিন দিনমজুর যুবরাজ বাগান পরিষ্কারের কাজ করছিলেন এবং শাহাবুদ্দিন গাছের ডাল কাটছিলেন। গাছের সারির পাশে ৩৩ হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক লাইন থাকা সত্ত্বেও সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পল্লী বিদ্যুৎ অফিসকে না জানিয়ে দিন মজুরদের গাছ কাটার কাজে লাগিয়ে দেন। তিনি দিনমজুর শ্রমিকদের কাজ করাতে লাগিয়ে দিয়ে ততকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী সহ অত্র অফিসের সমস্ত স্টাফ দের নিয়ে রাজারহাট উপজেলার এক উপ-সহকারী প্রকৌশলীর বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত খেতে চলে যান। সে দিন ছুটি থাকায় অফিসের অন্যান্য স্টাফরাও সেখানে দাওয়াতে অংশ নেন।

এদিকে বেলা আড়াইটার দিকে গাছের ডালে বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসে বিদ্যুতায়িত হয়। সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হন দিনমজুর শাহাবুদ্দিন। তার সঙ্গে থাকা অপর শ্রমিক যুবরাজ ঘটনাটি দেখে কি করবেন ভেবে না পেয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করেন। এক পর্যায়ে অফিসের বাহিরে থাকা কে বা কারা ফোনে অফিসের স্টাফ কে ফোন দিয়ে বলে এলজিইডির ভিতরে দুঃঘটনা ঘটেছে। পরে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হাসান আলী সহ স্টাফরা দাওয়াত খেয়ে ঘটনাস্থলে ফিরে এসে বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে অত্র অফিসের দুজন পিয়নকে দিয়ে শাহাবুদ্দিনকে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।সেখানে হাসপাতালের ভর্তি রেজিষ্টারে ওই শ্রমিকের নাম ভুয়া ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পরই চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য হাসপাতালের রেজিস্টারে মৃত ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করে লেখা হয় ‘সাজু মিয়া’(৭০) পিতার নামের স্থানে লেখা হয় সাথে থাকা অপর শ্রমিক যুবরাজের নাম। পরবর্তীতে রেজিস্টারের ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু’ অংশটি কলম দিয়ে কেটে দেওয়া হয়। এবং তরিঘরি করে দ্রুততম সময়ে লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই এম্বুলেন্স এ করে মৃতের লাশ তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নিহত শাহাবুদ্দিনের পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী ও তিন কন্যা সন্তান। তার কোনো পুত্রসন্তান নেই। বড় মেয়ে প্রতিবন্ধী। পরিবারে শোকের মাতম চলাকালে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও প্রভাবশালীরা মিলে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও সহকারি প্রকৌশলীর সঙ্গে গোপন সমঝোতার উদ্যোগ নেন। তাদের চাপে পড়ে দ্রুত নিজ বাড়ীর উঠানেই লাশের ময়নাতদন্ত ছারাই মৃত শাহাবুদ্দিন ওরফে রহিম বকশ এর লাশ দাফন করা হয়।

পরে কুলখানির জন্য এলজিইডি অফিস থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয় এবং নিহতের স্ত্রীর নামে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে তিন লাখ টাকা জমা করা হয়।

নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান জানান, ঘটনাস্থলের ৩৩ হাজার ভোল্টের লাইনটি ছিল পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের। গাছের ডাল কাটার আগে অবশ্যই পল্লী বিদ্যুৎ অফিসকে জানানো এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা জরুরি ছিল। কিন্তু এলজিইডি কর্তৃপক্ষ তা না করায় দুর্ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়। তিনি আরও জানান, “এলজিইডির ওই সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী শুধু ফোনে জানিয়েছিলেন, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। লোক মারা গেছে এটা আমি অন্যভাবে জানতে পারি। তখন আমি পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে খবর দিলে তারা জানায়, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।”

নিহতের ছোট ভাই সাবেনুর ইসলাম বলেন, “আমার ভাই মারা যাওয়ার পর লাশ বাড়িতে আসলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি এসে আপস-মীমাংসা করেন এবং আমাদের কিছু বলার সুযোগ দেন নাই। কুলখানির জন্য ১০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ টাকা ও দাপনের খরচ দেওয়া হয়। আমার ভাবির জন্য এলজিইডির এলজিএসপি প্রকল্পে মাটি কাটার কাজের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন, কিন্তু আমার ভাইয়ের মৃত্যুর ৭ মাস পড় আমার ভাবিকে চাকুরী না দিয়ে আমার প্রতিবন্দী ভাতিজীকে চাকুরী দেয়।

তিনি আরও বলেন, “ভাবির বয়স বেশি, তিনি অসুস্থ। পরিবারের বড় মেয়ে প্রতিবন্ধী। তাই কাজে যেতে পারেন না। মেয়েকে রেখে কাজ করা সম্ভব নয়।”

নিহত শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী বলেন, “আমার স্বামীই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি নিজেও অসুস্থ। যে মাটি কাটার কাজ দিয়েছে, সেখানে বেতন ৯ হাজার টাকা হলেও মাসে ৬ হাজার টাকা দেয়। কাজে কয়েকদিন গিয়েছিলাম, এখন অসুস্থতার কারণে যেতে পারছি না। নিজের এবং প্রতিবন্দী মেয়ের ওষুধপত্র আর সংসারের খরচ চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”

স্বামীর মৃত্যুর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি কিছুই জানি না। লাশ নিয়ে কান্নাকাটি করার সময় এলাকার কিছু নেতা ও অফিসের লোকজনের সঙ্গে সমঝোতা করে লাশ দাফন করেছে। আমি ভালো-মন্দ কিছুই বুঝিনি।
মামলা করার বিষয়ে আইনজীবীর সাথে কথা হলে তারা বলেন, মুতের পরিবারের যে কেউ নিকট আত্মীয় মামলা দায়ের করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে যদি তারা মামলা পরিচালনা করতে না পারেন তাহলে (লিগাল এইড)আইনি সহায়তা কেন্দ্র তাদের সহযোগিতা করবে।

বিষয়টি নিয়ে এলজিইডির ততকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী বর্তমানে বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুজ্জমানের সাথে কথা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি তো সমাধান হয়েছে, সেটা নিয়ে বারাবারি না করলে হয় না। আমি সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী কে বল দিচ্ছি প্রয়োজনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার টিকে আরো কিছু সহযোগিতা করা হবে।
এবিষয়ে কুড়িগ্রাম এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হাসান আলীর সাথে কথা হলে তিনি সবকিছু অস্বীকার করে টালবাহানা করেন, এবং ততকালীন নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে যোগাযোগ করতে বলে ফোন কেটে দিয়ে তার মনোনিত ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হয়ে তাদের দিয়ে এ প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে মানা ও চাপ প্রয়োগ করেন। শাহাবুদ্দিনের মৃত্যুতে ওই পরিবারটিতে কর্মক্ষম লোক না থাকায় বর্তমানে পরিবারটি অচল হয়ে পরেছে।

আরো দেখুনঃ