উপ-ব্যবস্থাপকের অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ কুড়িগ্রামে বিসিক উদ্যোক্তা মেলার নামে চলছে বাণিজ্য মেলা
শাহীন আহমেদ, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) আয়োজিত ১০দিনব্যাপী উদ্যোক্তা মেলা কুড়িগ্রাম জেলা উপ ব্যবস্থাপকের কারসাজিতে পরিণত হয়েছে বাণিজ্য মেলায়। বিনিময়ে উপব্যবস্থাপক একাই হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক লাখ টাকা।
এদিকে সাংবাদিকদের তথ্যানুসন্ধানের পর বুধবার সন্ধ্যায় স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিসিক উদ্যোক্তা মেলায় সকল বাণিজ্যিক রাইড বন্ধ করে দিলেও চলছিলো মেলার অন্যান্য কার্যক্রম।
সরেজমিনে মেলা ঘুরে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম বিসিকের রেজিষ্ট্রেশনকৃত বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের হস্ত ও কুটির শিল্প সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের জন্য ২৭শে নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০দিনব্যাপী উদ্যোক্তা মেলা বিসিক জেলা কার্যালয়ের উদ্যোগে ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আয়োজন করা হয়। মেলায় নেই তেমন স্থানীয় উদ্দোক্তাদের তৈরীকৃত হস্ত ও কুটির শিল্প সামগ্রী। প্রায় স্টলে সাধারণ বাণিজ্যিক পণ্যে ভরা। এছাড়া অনেক স্টল থেকে অজ্ঞাত কারণে সাইনবোর্ড নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। এছাড়া দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন স্টলের সামনে দোকানীদের ভেজা পোশাক শুকাতে দিলে অস্বস্তিতে থাকে মেলায় আসা লোকজন ও নারী উদ্যোক্তারা।
আরো জানা যায়, কুড়িগ্রাম বিসিকি মেলার জন্য সরকারি বরাদ্দ ধরা হয় ৩লাখ ৬০ হাজার টাকা। সরকারি বিধি অনুযায়ী স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ে এই মেলা আয়োজন করার কথা। কিন্তু মোট ৯৮টি স্টলের মধ্যে বিসিক নিবন্ধিত মাত্র ২০টি স্টল স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রতিটি স্টলের ভাড়া উদ্যোক্তাদের জন্য ২ হাজার টাকা ও নিবন্ধনহীন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্টল ভাড়া ৩ হাজার টাকা। স্টলের সাজসজ্জা, ব্যানার ও বৈদ্যুতিক বিল বাবদ একটি স্টলের জন্য প্রতিজন উদ্যোক্তার নিকট থেকে গ্রহণ করা হয়। তবে একাধিক স্টল গ্রহণকারীদের জন্য আরও অনির্ধারিত ভাড়া গ্রহণ করার কথা। কিন্তু নিবন্ধনহীন বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণকারী সাভার, রাজশাহী, ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলার ৪৫ ব্যক্তিকে ৭৮টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা ভাড়া তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের একজন উদ্যোক্তাকে বিশেষ সুবিধায় ভাড়া ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ৭৮টি স্টল উদ্যোক্তাদের না দিয়ে বাণিজ্য মেলায় যারা স্টল করে বেড়ায় তাদের হাতে তুলে দেওয়ায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর এই ৭৮টি স্টল এক হাত দুই হাত বদল হয়ে বাণিজ্য মেলার ব্যক্তি ‘শ’ আদ্যাক্ষরের ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়। এতে প্রতিটি স্টলের মূল্য দাঁড়ায় ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। এভাবে যারা ২/৩টি স্টল নিয়েছে তাদেরকে দিতে হচ্ছে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। এই হিসাবের মধ্যে সরকারি বিধি অনুযায়ী প্রতি স্টলের বিপরীতে অনিবন্ধিত হিসেবে ৩ হাজার টাকা সরকারিভাবে জমা করা হবে। কিন্তু প্রতিটি স্টল থেকে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা হিসেবে গড়ে বিসিক উপব্যবস্থাপক মোট ৪লাখ ৬৮হাজার টাকা পকেটস্থ করেন। এই টাকা তিনি বাণিজ্য মেলার সেই ব্যক্তির নিকট থেকে গ্রহণ করেন অগ্রীম হিসেবে।
বিশস্ত সূত্রে জানা গেছে, উপ-ব্যবস্থাপক রংপুরে অবস্থান করেন। এই ‘শ’ নামের ব্যক্তির সাথে তিনি লালমনিরহাটের তিস্তা এলাকায় মিটিং করে সেখানেই টাকা গ্রহণ করেন। আর এ সমস্ত কাজে উপ-ব্যবস্থাপক এর স্পেশাল সহকারী সুমন মিয়া সহযোগিতা করেন। এর বাইরেও বিসিকের একজন ও মেলার মধ্যস্থতাকারী আরেকজন ওইসব স্টলগুলো থেকে প্রতিদিন স্টল ভেদে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। অন্যদিকে মেলায় বসানো হয়েছে নৌকা, ট্রেইন, বক্সিং পয়েন্টের মতো কয়েকটি রাইড। এসব রাইড থেকে প্রতিদিন আয় হচ্ছে মোটা অংকের টাকা যার ভাগ যাচ্ছে বিসিকের উপব্যবস্থাকের পকেটে। সে হিসেবেও তার পকেটে ঢুকবে প্রায় লাখ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হওয়ায় বরাদ্দ পাওয়া দোকান মালিক-কর্মচারীর নিকট থেকে পাওয়া যাবতীয় প্রমাণ এই প্রতিবেদকের নিকট সংরক্ষিত রয়েছে।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, বিসিক উদ্যোক্তা হয়ে এসেছেন তাদের স্টল মেলার বাইরে অবস্থান করছেন। অথচ যারা উদ্যোক্তা নন এমন বাণিজ্যিক স্টলগুলোকে দেওয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গা। ভিতরে স্টল পাওয়া দোকানদাররা স্বীকার করেন যে, তারা বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে মেলায় এসেছেন স্টল প্রতি ৮-১০হাজার টাকার চুক্তিতে। তারা মূলতঃ বাণিজ্যমেলায় স্টল দিয়ে ব্যবসা করেন। তাদের অনেকে অভিযোগ করেন, তাদের স্টল থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন মালামাল চুরি হচ্ছে যা ঠেকানো যাচ্ছে না। তাদের দোকান থেকে জামদানী শাড়ি,শাড়ি, থ্রিপিস, আংটি চুরি হয়েছে। বিশেষ করে নাইটগার্ড থাকা সত্বেও রাতে মালামাল চুরি হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।
স্থানীয় ভেলুর বাজার থেকে মেলায় ঘুরতে আসা দম্পত্তি আশিকুর ও রত্না হতাশা প্রকাশ করে জানান, হস্ত ও কুটির শিল্প সম্ভার নিয়ে সাজানো থাকবে উদ্যোক্তা মেলা সেখানে বাণিজ্যিক পণ্যের দোকান দেখে বোঝার উপায় নেই এটি বাণিজ্য মেলা না কি বিসিকের মেলা।
মাহমুদ, নয়ন, শান্তা ও উর্মিসহ অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলমান। এ অবস্থায় স্কুল-কলেজ সংলগ্ন এই বাণিজ্য মেলা অপ্রয়োজনীয়। এটা আমাদের সাথে তামাশা ছাড়া কিছুই নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি খন্দকার খায়রুল আনাম বলেন, এই মেলা বিষয়ে কুড়িগ্রামের অনেক উদ্যোক্তা জানে না । সঠিকভাবে প্রচারণা করা হয় নি। তাছাড়া স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে।
এই সয়য়ে স্কুল সংলগ্ন মেলাটির আয়োজন করা উচিৎ হয় নি। বিশেষ সূত্রে জানতে পেরেছি, উদ্যোক্তা নন এমন দূরদূরান্তের ব্যবসায়ীদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি।
বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে উপব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ জোনায়েদ বলেন, মেলায় কোথাও বাঁধা নেই যে বাইরের উদ্যোক্তারা আসতে পারবে না। মেলার অনেকেই আগ্রহী না হওয়ায় বাইরের ব্যবসায়ীদের আনা হয়েছে। তাদের থেকে টাকা নেওয়া হয় নি। আমি ঢাকায় মিটিং এ আছি, ফিরে এসে কথা হবে।
জেলা প্রশাসক অন্নপূর্ণা দেবনাথ বলেন, মেলায় কোনো ধরণের দুর্নীতি বা অনিয়ম কাম্য নয়। সেখানকার বিভিন্ন বিষয়ে আপনাদের নিকট থেকে জানতে পারলাম। এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।