কুড়িগ্রামে দুধকুমার নদীকে হত্যা করেই ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প সমাপ্ত। নির্বাহী প্রকৌশলী কে নিয়ে প্রশ্ন।

শাহীন আহমেদ, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।

নদী বাঁচানোর কথা বলে নদীর বুকেই কবর খোঁড়া হয়েছে—এমন অভিযোগে ফুঁসছে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বলদী পাড়া গ্রাম। দুধকুমার নদী ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের নামে নেওয়া প্রায় ১৫ কোটি টাকার প্রকল্পটি এখন এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত “নদী হত্যার প্রকল্প” হিসেবে।

মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে গভীর খননের প্রয়োজন ছিল, সেখানে উল্টো নদীর মাঝ বরাবর বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে তলদেশ উঁচু করে দেওয়া হয়েছে। এতে কার্যত নদীর স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে মৃতপ্রায় জলাভূমি।

প্রকল্পের নামে পরিকল্পিত বিপর্যয
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), কুড়িগ্রাম বাস্তবায়ন করেছে।

কাজের নাম:
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার দুধকুমার নদীর ডান তীর (৪২৮২০–৪৩৩২০ কিমি), দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার

চুক্তি মূল্য: ১৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৯ টাকা,টেন্ডার আইডি: ৭৪৪৪০২৫,প্যাকেজ: কুড়ি/ দুধকুমার ডাবলু–৪৮,কাজের সময়কাল: জানুয়ারি ২০২৩ – জুন ২০২৫
বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার: আর ইউ এস এইচ জেভি
প্রতিনিধি: মো. মোস্তাফিজার রহমান সাজু (নাজিরা, খলিলগঞ্জ)
এই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়েছে যাত্রাপুর ইউনিয়নের বলদী পাড়া গ্রামসংলগ্ন নদী এলাকায়—যেখানেই আজ সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র।
খননের বদলে ভরাট: নদীর মাঝেই বাঁধ
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রকল্পের নামে নদীর মাঝখানে—

লক্ষাধিক ২৫০ কেজি ধারণক্ষমতার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে।নদীর স্বাভাবিক গভীরতা নষ্ট করে তলদেশ উঁচু করা হয়েছে।পানির চলাচলের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।নদী তীরবর্তী শাজাহান আলী বলেন,
“নদীর পেট কেটে নয়, নদীর পেটে জিও ব্যাগ ভর্তি বালু ভরে মারা হয়েছে। এখন এই নদী শুধু নামে আছে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর মাঝ বরাবর এমন ভরাট নদী ব্যবস্থাপনার চরম লঙ্ঘন এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে পুরো নদীপথ ধ্বংস করে দেয়।

জিও ব্যাগেই শেষ নদীর শ্বাস
বলদী পাড়া এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে—নদীর একাধিক স্থানে জিও ব্যাগ স্তূপ হয়ে চর তৈরি করেছে। বর্ষায় যেখানে প্রবল স্রোত থাকার কথা, সেখানে এখন পানিও নেই।

জেলে অমলেশ চন্দ্র বলেন,
“নদী শুকিয়ে গেছে। মাছ নেই, স্রোত নেই। আমাদের পেশাটাই শেষ।”

ঠিকাদার পলাতক, কাজ ফেলে উধাও
স্থানীয়দের দাবি, ঠিকাদার মো. মোস্তাফিজার রহমান সাজু বর্তমানে একাধিক মামলার আসামি এবং পলাতক রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতেই নদীর বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে জিও ব্যাগ ফেলে কাজ সমাপ্ত দেখানো হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে—
ঠিকাদার পলাতক থাকলেও বিল কীভাবে ছাড় হলো?
কার অনুমতিতে কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো?

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন

প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বে ছিলেন—মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান, নির্বাহী প্রকৌশলী,আব্দুল কাদের, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী,মো. শরিফুল ইসলাম
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাঠপর্যায়ে কার্যকর তদারকি না থাকায় ঠিকাদার ইচ্ছামতো কাজ করেছে। অনিয়মের অভিযোগ একাধিকবার উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, ডিজাইন মোতাবেক ও নিয়ম মেনেই কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

১৫ কোটি টাকার ফল—মৃত নদী
সরকারি অর্থ ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তব চিত্র—

নদীর প্রবাহ নেই,মাছের প্রজনন ধ্বংস,জেলে ও মাঝিদের জীবিকা সংকটে,নদী পরিণত হয়েছে শুকনো খাদে

যাত্রাপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ময়েন উদ্দিন ভোলা বলেন,“এই প্রকল্প তদন্ত হলে শুধু ঠিকাদার নয়, অনেক মুখোশ খুলে যাবে।”

এলাকাবাসীর দাবি তদন্ত না হলে আন্দোলন
বলদী পাড়া ও আশপাশের গ্রামের মানুষ দাবি জানিয়েছেন—
প্রকল্পটির দুদকের মাধ্যমে স্বাধীন তদন্ত, নদীর মাঝখান থেকে সব জিও ব্যাগ অপসারণ, দুধকুমার নদীর বৈজ্ঞানিক খনন ও প্রবাহ পুনরুদ্ধার, অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা

দুধকুমার নদী আজ আর শুধু একটি নদী নয়—এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও ভুল উন্নয়ন দর্শনের প্রতিচ্ছবি। উন্নয়নের নামে যদি নদী মরতে থাকে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উত্তরাধিকার পাবে শুধু শুকনো নদীখাত আর হারানো জীবনের গল্প।

এ কাজের দুর্নীতি তদন্তের দাবি
কুড়িগ্রাম জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন,
“জেলায় নদী শাসনের নামে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মূল ঠিকাদার কাগজে থাকলেও মাঠে দালালদের মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। বলদী পাড়ার প্রকল্পটি নিয়ে আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে। দুধকুমার নদী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—এ বিষয়ে দুদকের মাধ্যমে তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে আহ্বান জানানো হবে।

আরো দেখুনঃ