পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দুইযুগ ধরে তালা বদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়
ডিজার হোসেন বাদশা, পঞ্চগড় প্রতিনিধি।।
স্বাধীনতার তীর্থভূমি একাত্তরের মুক্তাঞ্চল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা। এই উপজেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাধায় প্রবেশ করতে না পারায় এই অঞ্চলকে মুক্তাঞ্চল বলা হয়ে থাকে। আর এ উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন ভজনপুর, বুড়াবুড়ি ও দেবনগড় মিলে রয়েছে একটি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কর্যালয় ও আঞ্চলিক আওয়ামীলীগ কার্যালয়। তবে অফিস কার্যালয়টি থাকলেও গত প্রায় দুই যুগ ধরে তালা বদ্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে অফিসে বসতে না পেরে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে অবহেলা অযত্ন ও অপরিচ্ছন্নতায় কার্যালয়টির বেহাল দশা। যেহেতু তেঁতুলিয়া ছিলো হানাদার মুক্ত পুরো এলাকা ছিলো মুক্তা অঞ্চল। এই অফিসে বসে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ৭১-এর গেরিলা ও সম্মূখ্য যুদ্ধের অনেক গুরুত্বপুর্ণ আলোচনা ও মিটিং করেছেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবী দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়রা ওই অফিসে উপস্থিত হয়ে প্রতিদিন কোলাহলে মুখরিত থাকতো। হঠাৎ ২৫শে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশীয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী প্রান্তিক এই উপজেলার ভজনপুরে তান্ডব শুরু করে। স্থানীয়দের ঘর বাড়ি দখলে নিয়ে এই অফিসটিও তাদের দখলে রাখার চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তী তারা অফিসটি দখলে নিতে ব্যর্থ হয়। আবারো দীর্ঘদিন অবহেলিত ভাবে পড়ে থাকে অফিসটি। ১৯৯৬-এ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর এই অফিসটি ক্ষুদ্র সংস্কার করে ২০০১ সালে নির্বাচনের আগেই বিএনপির সমর্থীতরা বন্ধ করে দেয়। ২০০১ এর নির্বাচনের পর স্থায়ী ভাবে অফিসটিতে তালা বদ্ধ করা হলেও সেই তালা আজো খোলা হয়নি।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭-ই মার্চের ভাষণের পর স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খাদেম আলী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে ভজনপুর বাজারে তৎকালীন জাতীয় সড়কের পাশ্বে খাস জমিতে একটি অফিস গড়ে তুলেন। এর পর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হলে ঐ অফিসে বসে যুদ্ধের জন্য অনেক গুরুত্বপুর্ণ আলোচনা করেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো তেঁতুলিয়াকে হানাদার মুক্ত রাখতে পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানার চাওয়াই সেতু ও ভজনপুর করতোয়া সেতু ডিনামাইন দিয়ে গুড়ীয়ে দেয়া হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান কিভাবে দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ থাকে এমন প্রশ্নে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রাও।
বর্তমান এই অফিসটি প্রবেশ মুখে দুটি চায়ের দোকান স্থাপন করায় এটি তীর্থস্থান নাকি চায়ের স্টোল বোঝাই মুসকিল। কি কারনে এমন গুরুত্বপুর্ণ একটি অফিস বন্ধ রয়েছে অনেকেরি তা অজানা। অফিসটি আগে আওয়ামীলীগ ও মুক্তিযোদ্ধা দু’ভাগে স্বমন্যয়ে ব্যাবহার করলেও বর্তমান প্রায় দুই যুগ থেকে কেউ তালা খুলছেনা। স্থানিয়দের দাবী ঐ অফিসের তালা খুলে বসার ব্যাবস্থা করাসহ মুক্তিযোদ্ধা কর্নার ও সামনে একটি বঙ্গবন্ধুর মুরাল তৈরী করলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ স্বাধীনতার তীর্থস্থান গুলিতে উন্নায়নের ছোয়া লাগেনি ৫০ বছরেও। দেবনগড় ইউনিয়নের আতমাগছ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সেরাজুল হক বলেন, এই অফিসটি বন্ধ থাকায় আমাদের দুঃখ লাগে, আমরা মিটিং ও বসার মত একটা অফিস পাই না। কি কারনে এমটা হয়েছে তা আমরা বলতে পারছি না। একই ইউনিয়নের পাথরঘাটা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলী বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এটি। আর এটিকে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে। আমরা এই অফিসটি চালু করার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি।
ভজনপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আলী বলেন, আমি ছোট থেকে আওয়ামীলীগকে সমর্থন করি এবং আওয়ামীলীগের রাজনীতি করে আসছি। ভজনপুর এলাকাটি বিএনপি অর্ধশিত তাই বিএনপি ক্ষমতা থাকা অবস্থায় আওয়ামীলীগ পরিচয় প্রদান করা বা সে সময় আওয়ামীলীগ করা খুবই কষ্টের বিষয়। আগে এ এলাকায় হাতে গোনা দশজনও আওয়ামীলীগ পরিচয় প্রদানকারি খুজে পাওয়া যেতো না। সে সময় থেকে আজো পর্যন্ত আওয়ামীলীগ করে আসলেও দীর্ঘদিন ধরে এ অফিসটি তালা বদ্ধ থাকায় আমরা মর্মাহত।
ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মনছুর আলী বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি আসার পর তারা স্থায়ী ভাবে অফিসটি বন্ধ করে দেয়। এর পর অফিসটি সেভাবে পড়ে আছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু অফিসটি খুলতে পারি নি। তেঁতুলিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন আলী মন্ডল বলেন, এই অফিসটার সংস্কারের যে কাজ আমরা সেই কাজ করবো। আর এই অফিসটি উদ্ধার করার জন্য আমাদের যা যা করার দরকার আমরা তা করবো। তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক কাজি মাহমুদুর রহমান ডাবলু বলেন, যদি সকলের সহযোগীতা পাই তবে এই অফিসটির আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে পারবো আমরা। একই সাথে ঐতিহ্যবাহী এই অফিসটির উন্নয়নে আমরা সব ধরণের কাজ করবো। তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। এই মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়টি খোলার জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর এই অফিসটি নিয়ে যে কোন সহযোগীতার প্রয়োজন হয় তা আমাদের জানালে আমরা সেই ব্যবস্থাও গ্রহণ করবো।
উল্লেখ্য, পঞ্চগড়ের ইতিহাসে ১৯৭১ সালে ১৭ই এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন পাক- বাহিনী দখল করে নেয় পঞ্চগড়। জ্বালিয়ে দেয় সাজানো গুছানো পঞ্চগড় শহর এবং হত্যাযজ্ঞ চালায় নির্বিচারে। এছাড়াও পাক হানাদার বাহিনীএদেশীয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় হাজারো নিরস্র জনগণকে হত্যা করে ,তাদের ধনসম্পদ লুটপাট করে ,ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এর পর মুক্তিযোদ্ধারা সংঘঠিত হয়ে ও ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাক বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দূসর, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা ও সন্মুখ লড়াই শুরু করে। এই এলাকায় ৭টি কোম্পানীর অধীনে ৪০টি মুক্তিযুদ্ধ ইউনিট পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়ন থেকে পুরো তেঁতুলিয়া উপজেলাকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সীমান্ত পরিবেষ্টিত ও ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে সংঘটিত হয়েছে ব্যাপক যুদ্ধ। বাংলাদেশে ৪টি মুক্তাঞ্চলের মধ্যে পঞ্চগড় মুক্তাঞ্চল যুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ণয়ে ও পরিকল্পনা প্রণয়নে অবিস্মরণীয়ভূমিকা রাখে। ৬নং সেক্টরের অর্ন্তগত মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী কমান্ডারের মধ্যে মাহবুব আলমের নেতৃত্বে ২৮ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা চার দিক থেকে পাক বাহিনীর উপর ঝড়ো আক্রমন শুরু করে এবং ২৯ শে নভেম্বর পঞ্চগড় পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়।
আহসানুজ্জামান সোহেল/অননিউজ24।।