সোনাগাজীতে ফসলি জমি অনাবাদি দেখিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পাঁয়তারা
সোনাগাজী (ফেনী) প্রতিনিধি।।
ফেনীর সোনাগাজীতে তিন ফসলি জমি অনাবাদি দেখিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এর প্রতিবাদে ধারাবাহিক আন্দোলনে রয়েছে সোনাগাজীর ভূমি মালিক ও কৃষকরা। এলাকাবাসীর দাবী বছরে তিন ধরণের ফসল চাষাবাদ হয় এসব জমিতে। বর্তমানে জমিতে রয়েছে সবুজ আমন ধান। আর কিছুদিন পরেই গোলায় উঠবে সোনালী ধান। শাকসবজি ও তরমুজের চাষও হচ্ছে এসব জমিতে।
এরপরও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ১৭৫ একর জমি লবণাক্ত, অনাবাদি ও পতিত। এভাবেই চাষাবাদের অনুপযোগী বলে ৫০ মেঘাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র দিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এসব মিথ্যা ছাড়পত্রের মাধ্যমে তিন ফসলি জমিগুলো অধিগ্রহণের পাঁয়তারায় ক্ষুব্ধ কৃষক ও ভূমি মালিকরা জমিগুলো রক্ষায় মাঠে নেমেছেন।
জমিগুলো অধিগ্রহণের জন্য ‘সোনাগাজী সোলার পাওয়ার লিমিটেড’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আবেদনের প্রক্ষিতে ফেনী জেলা প্রশাসন সোনাগাজীর থাক খোয়াজের লামছি মৌজার প্রস্তাবিত জমি নাল, পতিত অবস্থায় রয়েছে বলে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা সরজমিনে পরিদর্শণ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন জমিগুলো দুই বা তিন ফসলি।
কিন্তু গত ২৭জুন কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় ফেনীর উপপরিচালক সফি উদ্দিন স্বাক্ষরিত ছাড়পত্রে উল্লেখ করেন, ‘দেশের বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে ভূতাপেক্ষভাবে উক্ত সম্প্ত্কিগুলোর ব্যবহারিক শ্রেণি অকৃষি এবং বর্তমানে ব্যবহৃত হয়না। অথচ ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘অধিগ্রহণ প্রস্তাবে কৃষি জমি বিশেষভাবে দুই বা তিন ফসলি জমি অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা।
সে ক্ষেত্রে দুই বা তিন ফসলি জমি বাদ দিয়ে বিধিবিধানের আলোকে অন্যান্য জমি অধিগ্রহণের শর্তে অনাপত্তি প্রদান করা হলো’। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ফেনীর সাবেক উপপরিচালক সফি উদ্দিন তিনি বর্তমানে খাগড়াছড়িতে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন ‘আসলে এসব জমি এক ফসলি দেখানো হয়, তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কৃষি জমি ব্যবহার না করাই ভালো। তবে এর পূর্বে আপত্তির পরিবতর্তে অনাপত্তি কেন কেন দেখিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন আমার আগে কর্মরত উপপরিচালক তোফায়েল আহমেদ উক্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।
অধিগ্রহণে জমির পরিমাণ কমানোর জন্য ফের আবেদন করলে সে আলোকে আমি ছাড়পত্র দিয়েছি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার রীতিমত অবাক হয়ে বলেন, এই জমিগুলো তিন ফসলি। যেখানে কৃষকরা তিন ফসলের পাশাপাশি তরমুজ চাষ করে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদেরকে নিয়ে প্রতিবছর মাঠ দিবস পালন করে। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ছাড়পত্র সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেননা।
গত ২৮ জানুয়ারি ফেনীর তৎকালীণ জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান পতিত জমি উল্লেখ করে জমি অধিগ্রহণের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন। ১৭৫ একর জমির মধ্যে ৩২দশমিক ২৮ একর খাস, ৯ দশমিক ৭১একর বন্দোবস্তকৃত এবং অপরাপর জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান গত ৩০ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক বরাবর এক চিঠিতে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করেন।
অথচ পরিবেশ অধিদফতরের পরিদর্শণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে জমিগুলো আবাদি। গত ১২ এপ্রিল অধিদফতরের উপপরিচালক মো. সাইদুর রহমান ও পরিদর্শক ফাইজুল কবির যৌথ পরিদর্শণ প্রতিবেদন জমা দেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘ কৃষি দফতর। প্রস্তাবিত এলাকাটি লবণাক্ততার কারণে অনাবাদি বা চাষের অনুপযোগী মর্মে প্রত্যয়ন দাখিল করেছে। কিন্তু সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় লবণাক্তার কোন আলামত পরিলক্ষিত হয়নি।
তিন ফসলি রক্ষা কমিটির আহবায়ক সাবেক সেনা সদস্য জসিম উদ্দিন বলেন, থাক খোয়াজের লামছি মৌজায় তাঁর প্রায় ছয় একর জমি রয়েছে। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে জমিগুলোতে ফসল ফলিয়ে জীবীকা নির্বাহ করছেন। জীবন থাকতে জমিগুলো অধিগ্রহণ করতে দেয়া হবেনা। কৃষকদের নিয়ে তারা জমি রক্ষায় মাঠে আন্দোলনে রয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ফেনী-৩ আসনের সাংসদ, ফেনী জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট স্মারকলিপি সহ লিখিত আবেদন জানানো হয়েছে।
মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করা হয়েছে দফায় দফায়। এরপরও সৌরবিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের জমি অধিগ্রহণ তৎপরতা থেমে নেই। জমিরক্ষা কমিটির সদস্য সচিব মোশারফ হোসেন বলেন, তিনি সহ তাঁর স্বজনদের প্রায় আট একর জমি রয়েছে। জমিগুলো বিক্রিতে বাধ্য করতে সোলার পাওয়ার কোম্পানীর লোকজন তাঁর স্বজনদের হুমকি দিচ্ছে। তিন ফসলি জমি রক্ষায় তাঁরা শেষ লড়াই চালিয়ে যাবেন।
এলাকাবাসীর দাবীর প্রক্ষেতে গত ২০ অক্টোবর ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান প্রকল্প এলাকাটি পরিদর্শণ করেন। সেখানে কৃষকদের ক্ষতি হয় এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেননা বলে তিনি কৃষকদের আশ্বাস দেন। জেলা প্রশাসক বলেন, পরিদর্শণে দেখা গেছে জমিতে এখনো ধান রয়েছে। তবে আরো যাচাই-বাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সোনাগাজী সোলার পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসকে আবু মেহেদী বলেন, কৃষকরা নিজেদের ইচ্ছায় তাদের কাছে জমিগুলো বিক্রি করছেন। ইতোমধ্যে ১৫ একর জমি তাঁরা ক্রয় করেছেন। নিজাম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি কোম্পানীর লোকজনের কাছে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে কৃষকদের নিয়ে আন্দোলন করছেন।
আয়েশা আক্তার/অননিউজ24