কলের গান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
আবদুল আজিজ মাসুদ
অনেকে বলে পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে লাভ নেই। আমি বলি, লাভ আছে,যদি পুরনো রেকর্ড এখনো বাজে। না বাজলেই বা কি? এন্টিক লাভারদের কাছেতো মহামূল্যবান সম্পদ।
সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ” কলের গান – সে কাল এ কাল ” শীর্ষক বিশেষ প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। থরে থরে সাজানো ঔপনিবেশিক যুগের ‘ হিজ মাস্টার ভয়েজ( এইচ এম বি,)গ্রামফোন কোম্পানির চোঙা বা এক্সটারনাল হর্ণ এর সামনে বসা কুকুরের ট্রেড মার্ক ওয়ালা গ্রমোফোন মেশিন, রেকর্ড। দেখে মনে হয়েছিল’ অচল যন্ত্র, কিন্তু না! গ্রামোফোন মেশিনের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দম দিলেই সচল। ঘুর্নায়মান রেকর্ডে,বাঁকানো হাতলের মাথায় লাগানো পিন স্পর্শ করালেই বেজে ওঠে সেকালের বিখ্যাত শিল্পীদের কালোজয়ী গান, এঁদের মধ্যে নজরুল সংগীত শিল্পী হরিমতি, ইন্দুবালা,কাননবালা,আঙুর বালা, আব্বাস উদ্দিন, শচীন দেব বর্মন, কমল দাশ গুপ্ত সহ আরো বিখ্যাত শিল্পীদের গান।ত্রিশ / চল্লিশ এর দশকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ছিলেন এইচ এম বি কোম্পানির সংগীত ট্রেনার।নজরুল গান রচনা ও সুর করে শিল্পীর কন্ঠে তুলে দিতেন।
সুকন্ঠী, অভিনেত্রী হরিমতির কন্ঠে নজরুলের ” ঝরা ফু ল দলে কে অতিথি / সাঝের বেলা এলে কানন বীথি ” অথবা ” কে নিবি ফুল,কে নিবি ফুল / চামেলি যুথি বেলী,মালতি/ চাঁপা গোলাপ বকুল ” কার না শুনতে ভালো লাগে? কানন বালার অনবদ্য কন্ঠে ‘ ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বন ফুলগো’ অথবা নজরুলের ‘ আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ এ সমস্ত গান ত্রিশ/ চল্লিশ এর দশকে ছিল ঢাকা কলকাতা বাসীর মুখে মুখে।
প্রদর্শনীতে শিল্পী সম্পর্কে বিভিন্ন পোস্টার, ক্যাপশনে উল্লেখ রয়েছে” বাঈজী ও বারাঙ্গনাদের সামাজিক ভাবে যতই অপাঙ্কতেয় করে রাখা হোক না কেন, এরাই সে সময় মানুষকে দিয়ে ছিল বিনোদনের মূল খোরাক। সঙ্গীত,নৃত্য শিল্প কলার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শাখার বিকাশে তাদের অবদান ছিল অভূতপূর্ব, তাঁদের গড়া পথেই পরবর্তী সময়ে শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা স্বচ্ছন্দে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পা ফেলতে পেরেছিল, কিন্তু তাদের অবদানের কথা এখন বিস্মৃত প্রায়, এমন কি তাদের নামই হারিয়ে গেছে “। ” অভিনেত্রী কাননবালা দেবী(১৯১৬-১৯৬~১৯৯২) তাঁর স্মৃতি কথায় বলেন,”আমি মানুষ সেই পরিচয়টাই আমার কাছে যথেষ্ট। ” অন্ধকারে জন্মেও তারা আলোর দিশারী,বাঈজী থেকে দেবী হতে পেরেছিলেন তারা সংগীতকেই সঙ্গী করে।আর সেই পথটি ছিল বরাবরই চোখের জলে সিক্ত। ” ত্রিশের দশেকর নামকরা বাঈজী সুকন্ঠী হরিমতি ঢাকার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ( ১৯৩১)” দি লাস্ট কিস” এ অভিনয় করেছিলেন। হরিমতি কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং শৈশবে বিধবা হয়ে ঢাকা চলে আসেন পরে আবার কলকাতায় ফিরে যান।হরিমতির ছোট বোন বাঈজী রাজবালার মেয়ে বিখ্যাত ইন্দুবালা( ১৮৯৮-১৯৮৪)।
‘সেকালের কলিকাতার যৌনাচার ‘ গ্রন্হে মানস ভান্ডারী ইন্দুবালা সম্পর্কে লিখেন, ” তাঁর মা দিদিমা ছিলেন রামবাগানের পতিতা।অন্ধকারের জীবনে তিনি ও প্রথমে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।পরবর্তী জীবনে খ্যাতি ও উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হলেও তিনি কখনো কোথাও নিজের পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেননি। পতিতা পল্লীতে তাদের তিন পুরুষের বসবাস।সেই জায়গায় তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করতে চেয়েছেন।” তিনি অন্যত্র বলেছেন, ” পাড়া বদলে নামের শেষে ‘ বালা’ বাদ দিয়ে আমি দেবী হতে পারবোনা “। ইন্দুবালা বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, উর্দু, তামিল ভাষায় গান গেয়ে দেশ বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনশ’ র বেশি রেকর্ড। মুম্বাই চেন্নাই গিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা ৫০। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের লেখা গল্প অবলম্বনে One Fatal Night নামে ১৯৩৬ সনে নির্মিত উর্দু ছবিতে অভিনয় করেন।১৯২৬ সালে কলকাতা রেডিও ‘ র উদ্বোধনের দ্বিতীয় দিনে গান করেন।শুধু নজরুলেরই লেখা ৪৮টি গান রেকর্ড করেছেন।কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।সম্মান, প্রতিষ্ঠা,মেডেল, সংবর্ধনা পেয়েছেন প্রচুর।তাঁর রেকর্ডের গান শুনেছেন রবীন্দ্রনাথ। ”
সে কালে অর্থাৎ মোগল ব্রিটিশ যুগে যখন রঙ্গ মঞ্চে নারী চরিত্র অলিখিত নিষিদ্ধ বা সংকট ছিল তখন এই বাঈজী বারাঙ্গনাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনুপ্রবেশে চলচ্চিত্র ও মঞ্চে ব্যাপক আ়লোচনা সমালোচনার সূত্রপাত ঘটায়। সেকালে নটকে পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতো।
১৮৭৩সালে বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা হলে মধুসূদন দত্তের ‘ শর্মিষ্ঠা ‘ নাটকে নিষিদ্ধ পল্লীর সুকুমারী দত্ত বা গোলাপ সুন্দরী অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ান।পরে মেঘনাদ বধ কাব্য(১৮৭৭) সহ অন্যান্য নাটকে এই নিষিদ্ধ পল্লীর নারীরাই অভিনয় করেন।
সেকালের ঢাকা ছিল নাচ গানে ভরপুর। নিজস্ব বাগানবাড়ি বা নাচ মহলে বাঈজী নৃত্য ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। সুবেদার ইসলাম খাঁ ‘ দরবারে প্রায়ই মেহ ফিল বা নাচ-গানের আসর বসতো।তাঁর দরবারে বারোশ কাঞ্চনী অর্থাৎ নর্তকী ছিল। তাঁদের পেশা ছিল নাচগান করা।ঢাকা ছিল সঙ্গীত ও তালের শহর।উনবিংশ শতাব্দীতে নবাব দের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঈজীদের নাচগানের উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ লাভ করে। বাঈজীরা প্রায়ই তখন আহসান মনজিল, শাহবাগের ইসরাত মনজিল, দিলকুশার বাগান বাড়িতে নাচগানের মেহ ফিলে অংশ নিতেন।বিখ্যাতগহরজান,মালাকাজান,বেগম আখতার,জদ্দন বাঈ,মুসতারী বাঈ,কলকাতা থেকে ঢাকার মেহ ফিলে অংশ নিয়েছিল।
মালাকাজান, গহরজান সম্পর্কে জানা যায় গহরজান ১৮৬৩ সালে প্রথম কলকাতায় আসেন হায়দরাবাদের নিজামের পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি মহীশুর রাজদরবারেও সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তিনি ইন্ডিয়ান নাইটিঙ্গেল উপাধি পেয়েছিলেন।তাঁর মা মালাকাজানও বিখ্যাত বাঈজী ছিলেন এবং কবি ও গীতিকার ছিলেন।তারা দু-জনেই খৃষ্টধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছিলেন।
সে দিনের বিশেষ প্রদর্শনীতে ষাট সত্তর দশকের সেই সোনালী যুগের চলচ্চিত্রের গানের অংশ বিশেষ প্রদর্শনী দর্শকশ্রুতাদের মুগ্ধ করেছে। প্রদর্শনীতে স্হান পেয়েছে ষাটের দশকে ঢাকার ব্যান্ড সংগীতের সূচনার ইতিহাস। ষাটের দশকে নাজমা জামান জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী ঢাকায় ব্যান্ড সংগীতের সূচনা করেন। ই এম আই রেকর্ড কোম্পানি ১৯৬৯ সালে জিংগা গোষ্ঠীর প্রথম রেকর্ড বের করে।” উইন্ডি সাইড অব কেয়ার” ব্যান্ড সংগীত শিল্পী গোষ্ঠী ১৯৬৫ সালে শাহবাগ হোটেল, ঢাকা ক্লাব, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়মিত পারফর্ম শুরু করে।তখন এই দল ছিল তরুণদের ক্রেজ।তাঁরাই প্রথম ইন্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে দর্শনীর বিনিময়ে কনসার্টের আয়োজন করে। ই এম আই রেকর্ড কোম্পানি তাদের একটি রেকর্ড বের করে।