কুবির কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার পানিতে ময়লা; স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা

মো. সাজিদুর রহমান : কুবি ।।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা না থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন ধরে অপরিশোধিত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। নোংরা ট্যাংকের পানি কোনরকম ফিল্টারিং না করেই প্লাস্টিকের বোতলে করে খাবার পানির চাহিদা মিটাচ্ছেন ক্যাফেটেরিয়া কতৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে রয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা অভিযোগ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে পানির ট্যাংক পরিষ্কার না করার ফলে ট্যাংকির তলানিতে জমেছে পুরু ময়লার স্তর, যা কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ফিল্টার ছাড়াই এখানকার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে খাবারের জন্য। খাবার পরিবেশনার ক্ষেত্রেও অব্যবস্থাপনা চরমে। পাশাপাশি, ক্যাফেটেরিয়ার পিছনের অংশ যেখানে সবজি, চাল ধোয়া হয় এবং রান্নার কাজ চলে সেটির অবস্থাও শোচনীয়। পুরো জায়গাটি নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে। ড্রেনে জমে থাকা পানির কারণে সেখানে পোকামাকড়, মশা-মাছির উৎপাত বেড়েছে, যা খাবারের সংস্পর্শে এসে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্যাফেটেরিয়ার খাবার খান। এর পাশাপাশি বাইরে থেকে শালবনসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরতে আসা শতশত মানুষ ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার খেতে আসেন। তবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দাম অনুযায়ী খাবারের নিম্নমান, বিশুদ্ধ পানি, ওয়াশরুম নিয়ে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অপরিষ্কার প্লেটেই খাবার পরিবেশন করা হয়।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ রাসেল চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার এমন বেহাল দশা নেওয়া যায় না। খাবারের কোনো মান নেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই, পানির ট্যাংক গুলোর নাজেহাল অবস্থা। তাছাড়াও ক্যাফেটেরিয়ায় যেখানে রান্না করা হয় এর সাথেই রয়েছে ওয়াশরুম যা খুবই নোংরা। রান্নাবান্নায় জড়িত ব্যক্তিরা খুবই অপরিচ্ছন্ন। ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের একের পর এক অভিযোগ থাকলেও প্রশাসন সেদিকে চোখে পড়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শোয়েব হোসেন আলামিন জানান, ‘খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের, পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার অবস্থা খুবই করুণ। অনেক সময় কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই হুট করে ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার ফলে মেস এবং হলের শিক্ষার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন। খাবারের দাম বৃদ্ধি পেলেও মানের কোনো উন্নতি নেই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আগের দিনের বেঁচে যাওয়া খাবার নতুন করে পরিবেশন করা হয়, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।’

লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মন্দিরা দাস ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ বলেন, ‘একবার খাবার খাওয়ার সময় ডালের মধ্যে মাছি পেয়েছিলেন, যা তাকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে। এরপর থেকেই ক্যাফেটেরিয়ায় খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘অপরিষ্কার বোতলে অপরিশোধিত পানি দেওয়া হয়, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। খাবার খাওয়ার পর ব্যবহৃত প্লেটগুলো টেবিলেই পড়ে থাকে, এবং সেই একই প্লেটে আবার খাবার খেতে হয়।’

এদিকে চিকিৎসক বলছেন এই অপরিশোধিত পানি পানের ফলে হেপাটাইটিস এ, টাইফয়েড, কলেরাসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের ডেপুটি চীফ মেডিকেল অফিসার ডা. মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আমরা জানি বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। সুস্থ জীবনের জন্য বিশুদ্ধ পানি পান করা প্রয়োজন। অপরিশোধিত পানি যদি দীর্ঘ দিন পান করে খাবার পরিবেশনের জায়গা ও মাধ্যমগুলো যদি অপরিষ্কার থাকে তাহলে বিশেষ করে হেপাটাইটিস এ, টাইফয়েড ফিভার, ডায়রিয়া, কলেরা ছাড়াও নানান পানিবাহিত রোগ হয়।

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা মাঝে মধ্যেই টাইফয়েড, ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মেডিকেলে সেবা নিতে আসেন। স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচতে ফিল্টার করা পানি সবাইকে দিতে হবে এবং পরিষ্কার পাত্রে তা দিতে হবে। এব্যাপারে ক্যাফেটেরিয়া কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে ক্যাফেটেরিয়ার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মান্নু মিয়ার অনুপস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব পালন করছি। আমি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি কিভাবে সবকিছু সুন্দর ভাবে পরিচালনা করা যায়। আমি দায়িত্বে এসে ওয়াশরুম, বেসিন, ক্যাফের সামনের ময়লা আবর্জনা গুলো পরিষ্কার করেছি। আজকে পানির ট্যাংক গুলো পরিষ্কার করেছি। ক্যাফে ময়লা ফেলার জন্য ঝুড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সবকিছু তো একা করা সম্ভব না, সেক্ষেত্রে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদেরও সহযোগিতা প্রয়োজন।’

ছুটির দিন ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ রাখার বিষয়ে তিনি জানান, ‘ক্যাফেটেরিয়ার পরিষ্কার পরিছন্নতার জন্য আসলে ছুটির দিন ক্যাফ বন্ধ রাখছি। ছুটির দিন শিক্ষার্থী কম খেতে আসে এতে করে আমার অনেক খাবার থেকে যায়, যা নষ্ট হয় অথবা পরদিন খাওয়াতে হয়। যার কারণে ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ রাখছি আপাতত।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার সার্বিক অবস্থা নিয়ে ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা কার্যালয়ের পরিচালক ড. মোঃ আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, ‘ক্যাফেটেরিয়া প্রত্যাশিত মান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না, যা সবাই জানেন। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং খুব শিগগিরই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হবে। পানির ফিল্টারসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে। আজই পানির ট্যাংকগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে শরিফ সাময়িকভাবে ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব পালন করছেন, তবে শিগগিরই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে। গত ১৫ বছরে ক্যাফেটেরিয়ায় কোনো বড় ধরনের সংস্কার হয়নি। তবে এবার শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত দিচ্ছি খুব শিগগিরই ক্যাফেটেরিয়ার উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু।

আই/অননিউজ২৪।

আরো দেখুনঃ