কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন লালন স্বরণোৎসব শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার থেকে

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি।।
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) শুরু হচ্ছে বাউল শিরোমনি ফকির লালন শাহ এর ১৩৩তম তিরোধান স্মরনে তিন দিনের স্মরণোৎসব। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লালন একাডেমী, জেলা প্রশাসন ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার (অক্টোবর ১৭-১৯) পর্যন্ত এই আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এ উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। লালন আঁখড়াবাড়িতে জড়ো হচ্ছেন সাধু ভক্ত-অনুসারীরা। এবারে অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে- লালন মঞ্চে সন্ধ্যায় আলোচনা সভা, গভীর রাত পর্যন্ত রাতে লালন মঞ্চে গান পরিবেশন করবেন দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে আগত খ্যাতনামা শিল্পীরা। আখড়াবাড়ির মাঠে এবারো বসেছে গ্রামীন মেলা।

লালন শাহের মাজার খেদমতে উৎসর্গীকৃত খাদেম মোহাম্মদ আলী শাহ বলেন, দুর দুরান্ত থেকে এখানে আগত ভক্তরা মনে করেন, দুই হাজার বছর পূর্বে দার্শনিক সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত ‘বানী নো দাই সেলফ’ এর মতো মর্মকথা যেভাবে মানুষের মনে দাগ কেটেছিলো এবং বিশ্ব সভ্যতার ক্রমবিকাশকে প্রভাবিত করেছিলো। এতোকাল পরে এসে আধ্যাত্মিক চিন্তার দার্শনিক মহামতি লালনের সংগীত ও ধর্ম-দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে মুক্ত চিন্তক গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যদিও এর আগে কার্যত বাউল সাধক ফকির লালন শাহের জীবদ্দশা থেকে চলে আসা দোল উৎসব এবং তিরোধান দিবস স্মরণে (১লা কার্তিক ১২৯৭) কে (১৭৭৪-১৮৯০) ঘিরে এই আধ্যাত্মিক দর্শনের গুরু লালন শাহের ভক্ত অনুসারীরা একেবারেই নিজস্ব ঘরানার রীতিতে আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সাঁইজিকে স্মরণ করতে এদিনটির জন্য অপেক্ষা করেন। তারই বাধভাঙ্গা সাধুর জোয়াড়ে কানায় কানায় পরিপূর্ন হয়ে উঠেছে সাইজির তীর্থ ধাম।

গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন, বাউল সাধক ফকির লালন ছিলেন আধ্যাত্মিক দর্শন ও ভাবজগতের শিরোমণি। ফকির লালন সাঁইজি একাধারে গীতিকার, সুরকার, গায়ক, বাউল স¤প্রদায়ের গুরু, ধর্ম বর্ণ গোত্র স¤প্রদায়ের উর্দ্ধে মানবতাবাদী মনিষী ও লৌকিক ধর্মাচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম পুরোধা। তার গানের বানীগুলি দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গবেষনা ক্ষেত্রে বিস্তৃত। লালন কেবল বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষ নয় গোটা বিশ্বের গবেষকদের কাছে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর প্রথম সারির অন্তত তিন ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে লালনকে নিয়ে গবেষনা চলছে। লালন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া নয়; বাংলাদেশ নয়; ভারতবর্ষ নয় গোটা বিশে^র সম্পদ। এখন কথা হলো- লালন যে পারিপাশির্^কতা ও জীবনাচারের মধ্যদিয়ে লালন হয়েছেন সেই বাস্তবতা থেকে বিচ্যুৎ হয়ে তো আর লালন হবে না। লালন বুঝতে, জানতে বা ভাবতে চাইলে লালন অনুসারী সাধু গুরু বাউল ফকিরদের মতো করেই তা করতে হবে। জোর করে বা চাপিয়ে দেয়া কোন নিয়ম নীতির মধ্যদিয়ে লালন চর্চা অসম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকবৃন্দ লালনকে নিয়ে রীতিমতো গবেষনা করছেন। তারাও ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন লালন চর্চা কেবল লালন দর্শনের ভিত্তিতেই সম্ভব। এখন কথা হলো- সেভাবে হচ্ছে কি না? কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়া লালন শাহের মাজার প্রাঙ্গনে স্থাপিত লালন একাডেমীতে লালন চর্চায় কতদুর এগিয়েছে ? বা এগোনোর সম্ভাবনা আছে কি না ? লালন নিয়ে যারা গবেষনা করেছেন বা করছেন তারা সবাই অভিন্ন মত দেন যে, সরকারী প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে লালনকে আটকে রেখে লালন চর্চার দ্বার মুক্ত করা যাবে না। একাজটি করতে হলে অবশ্যই এখানে দেশে দুর দুরান্ত থেকে আগত বাউল সাধুদের মনের ভাষা বুঝে তাদের জন্য একটা অনুকুল পরিবেশ নিশ্চিত করে লালন ভাবনাকে প্রসারনের সুযোগ করে দিতে হবে। মানুষের এহজাগতিক জীবনাচার যেমন নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত; তেমনি ভাবে এখানে আগত সকল বাউল সাধকদের মনের ভাব বিনিময়ের মধ্যদিয়েই সমৃদ্ধ করতে হবে লালনকে। তিনি তার রচনা ও গ্রন্থনায় ‘উত্তর লালন চরিত’ শীর্ষক নাটকেও এমন একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন। তার মতে, প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে লালনকে আটকে না রেখে সরকাররের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের উদ্যোগে লালনকে বিশ^ দরবারে তুলে ধরতে যারা কাজ করেছেন সে সব গবেষক, শিল্পী, এবং প্রধান লালন আঁধার খ্যাত বাউল সাধক ফকির, ভক্ত অনুসারীদের সমন্বয়ে উন্মুক্ত মত বিনিময়ের মাধ্যমে একটা সুন্দর দিক নির্দেশনার মধ্যদিয়ে লালন চর্চার প্রকৃত স্বরূপ বেড়িয়ে আসতে পারে। এতে যে ভাব দর্শনে বিশ^ মানবতায় মুক্তির বার্তা লালন দিতে চেয়েছেন তার বিস্তৃতি ঘটবে।

লালন শাহের ১৩৩তম স্মরণোৎসব উদযাপনে ৩দিনের আয়োজনকে ঘিরে লালন একাডেমী, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সকল প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমীর সভাপতি মো: এহেতেশাম রেজা।

এফআর/অননিউজ

আরো দেখুনঃ