তেল, চিনি সংকটের সুরাহা কবে

অনলাইন ডেস্ক ।

এক মাসের বেশি সময় ধরে বাজারে চিনির তীব্র সংকট চলছে। দুই-এক দোকানে পাওয়া গেলেও দাম আকাশচুম্বী। সরকারের তরফ থেকেও সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নেই। ফলে এ বাজার থেকে ও বাজারে ঘুরেও চিনির দেখা মিলছে না।

এক কেজি চিনির জন্য কারওয়ান বাজারের অন্তত ১০টি দোকান ঘুরেছেন রবিউল ইসলাম। কিচেন মার্কেটের নিচ ও দ্বিতীয় তলায় সোমবার তন্নতন্ন করে খুঁজেও চিনির দেখা পাননি এ শিক্ষক।

তার ভাষ্য, ‘এক কেজির দাম যদি ৫০০ টাকাও হয়, তারপরও তো পণ্যটি বাজারে থাকবে! উধাও করে দেয়ার উদ্দেশ্য কী?’

এক মাসের বেশি সময় ধরে বাজারে চিনির তীব্র সংকট দেখছেন রবিউলের মতো অনেকে। দুই-এক দোকানে পাওয়া গেলেও দাম আকাশচুম্বী। সরকারের তরফ থেকেও সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নেই। ফলে এ বাজার থেকে ও বাজারে ঘুরেও চিনির দেখা মিলছে না।

এদিকে এ মাসের শুরু থেকে বাজার থেকে উধাও হয়েছে ভোজ্যতেল। উৎপাদন কম হচ্ছে অজুহাতে সব পর্যায়ে সংকট সৃষ্টি করে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে দাম, কিন্তু সত্যতা যাচাই করতে বাজার যাচাই করেনি সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান। শুধু চিনি আর তেলই নয়। আটা ও মসলার দাম বাড়ছে হু হু করে।

লম্বা সময় চিনির সংকট

লম্বা সময় ধরেই চিনি নিয়ে সংকটে পড়েছে ক্রেতা। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের দেখা মিলছে না। যাও দুই-এক দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, তার কেজি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা।

চিনি সংকটে ব্যাহত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা পরিচালনা। বাসাবাড়িতেও স্পষ্ট চিনির শূন্যতা, কিন্তু সরবরাহ নিশ্চিতে নেয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ।

রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় চা বিক্রি করেন বিল্লাল মিয়া। প্রতিদিন প্রয়োজন হয় তিন কেজি চিনি, কিন্তু এতটুকু চিনি জোগাড় করতেই যেন ঝক্কির শেষ নেই।

তিনি বলেন, চিনি জোগাড় করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। দোকান বন্ধ করে রাতে চিনির জন্য বের হতে হয়।

কারওয়ান বাজারে শরবত বিক্রি করেন মোশাররফ হোসেন। দিনে এই ব্যবসায়ীর দরকার হয় অন্তত ছয় থেকে সাত কেজি চিনি, কিন্তু একে তো দাম বেশি, অন্যদিকে পাওয়া যায় না। তাই চিনির বদলে এখন গুড়ই ভরসা।

তিনি বলেন, চিনি পেলেও দাম বেশি। গুড়েই পড়তা হয়।

কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে জিলাপি তৈরি করে বিক্রি করেন মিলটন। তিনি বলেন, চিনি না পাওয়ায় জিলাপি বিক্রি কমিয়ে দিতে হয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চিনি উৎপাদক সমিতির বৈঠক হয় গেল সপ্তাহে। সেখানে ব্যবসায়ীরা উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে গ্যাস স্বল্পতাকে দায়ী করেন।

মন্ত্রী আশ্বাস দেন স্বল্প সময়ে এ সংকট কেটে যাবে, কিন্তু এখনও পরিস্থিতির উন্নতি নেই। ওদিকে বাজারে যাও চিনি মিলছে, তা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না।

নির্ধারিত দাম কত

৪ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চিনির বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশি প্যাকেটজাত এক কেজি চিনির দাম ৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, কোনো বিক্রেতা এর থেকে বেশি দামে দেশি চিনি বিক্রি করতে পারবেন না।

এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৬ অক্টোবর খোলা চিনি ৯০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়, কিন্তু বাস্তবে নির্ধারণ করে দেয়া কোনো দামই কার্যকর হয়নি। উল্টো সরবরাহ ঘাটতির উল্লেখ করে দাম ক্রমে বেড়ে চলেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোতে ৩০ হাজার টন চিনি উৎপন্ন হয়। বাকি চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

চিনি চেয়ে ব্যবসায়ীদের চিঠি

চিনির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী।

কারওয়ান বাজারের মেসার্স রাহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মাহফুজুর রহমান চারটি কোম্পানি থেকে চিনির চাহিদা দেন।

তিনি তীর ব্র্যান্ডের ৩২০ বস্তা, ফ্রেশের ৩২০ বস্তা, ইগলুর ৩২০ বস্তা এবং দেশবন্ধু চিনির ৩২০ বস্তার চাহিদা দেন।

এই বাজারের মেসার্স আমিন জেনারেল স্টোরের মিজানুর রহমানও ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) কাছে চিনি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। এই ব্যবসায়ীও ৩২০ বস্তা করে চারটি কোম্পানি থেকে চিনি চেয়ে আবেদন করেন।

ব্যবসায়ীরা বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক সভায় চিনির সংকট হলে অবগত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ব্যবসায়ীরা তাই চিনি চেয়ে আবেদন করেন।

দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব, তেল হাওয়া

লিটারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৫ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে তেল উৎপাদক সমিতি। নতুন প্রস্তাবে ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৯৩ টাকা, ৫ লিটার ৯৫৫ টাকা, ১ লিটার খোলা সয়াবিন ১৭৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

চলতি মাসের প্রথমেই দাম বৃদ্ধির আবেদন করা হলে ট্যারিফ কমিশনকে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনার জন্য নির্দেশনা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী দাম প্রস্তাব হলে মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে কোনো দাম নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে দাম কার্যকর না করায় তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

খুচরা কিংবা পাইকারি সব পর্যায়ে তীব্র হয়েছে তেলের ঘাটতি। ক্রেতারা ঘুরছেন এ দোকান থেকে ও দোকান, কিন্তু দ্রুত পাচ্ছেন না তেলের দেখা। দোকানিরা বলছেন, কোম্পানি ডিও বা চাহিদাপত্র নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

এর আগে বেশ কয়েকবার তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের পরই সরবরাহে সংকট তৈরি করে তেল উৎপাদক একাধিক প্রতিষ্ঠান। তৈরি হয়, বাজারে অস্থিরতা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন।

মসলার বাজারেও উত্তাপ

বাড়ছে মসলাজাতীয় পণ্যের দাম। আমদানিনির্ভর বেশিরভাগ মসলায় কেজিতে দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। জিরা, কাজু বাদাম, লবঙ্গ, এলাচসহ কয়েকটি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহ কমায় বাড়ছে দাম।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বেশিরভাগ মসলার দামই ঊর্ধ্বমুখী। পাইকারি পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির প্রভাব গিয়ে পড়ছে খুচরা পর্যায়ে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে জিরার দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে প্রায় ১০০ টাকা; বেড়েছে লবঙ্গের দামও। কাজু ও কাঠ বাদামেও বাড়ার প্রবণতা।

পাইকারি পর্যায়ে সাড়ে ৪০০ টাকার কিসমিসের কেজি এখন হয়েছে প্রায় ৬০০ টাকা। এলাচের কেজি এখন সাড়ে ১৩০০ টাকা। বেড়েছে দেড় শ টাকার বেশি। দারুচিনির দামও ক্রেতার নাগালে নেই।

দামের দৌড়ে আছে আটাও

সপ্তাহ দুয়েক আগে এক দফা বেড়েছিল আটার দাম। তখন প্রতি কেজির দাম ছিল ৬৫ টাকা, তবে আরেক দফা বেড়েছে সব ধরনের আটার দাম। বাজারে নতুন আসা প্যাকেটজাত দুই কেজি আটার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য এখন ১৪০ থেকে ১৪২ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি আটার দাম পড়ছে ৭০/৭১ টাকা। দুই কেজি প্যাকেটজাত লাল আটা ১৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমে গেছে। ডলারের দাম বাড়ার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানিও কমেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত আটা বাজারে নেই। আবার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম সমন্বয় করা হয়েছে।

বাড়তি দরের আটা বাজারে আসার আগে কয়েক দিন বাজারে এর সংকট ছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো তখন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ীরা।

আরো দেখুনঃ