ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বীরকুৎসা হাজার দুয়ারী রাজবাড়ি

আবু বাককার সুজন।।

রক্ষণাবেক্ষণ ও সংষ্কারের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বাগমারার প্রাচীনযুগের ঐতিহাসিক নিদর্শনের অন্যতম স্থান বীরকুৎসা হাজার দুয়ারী রাজবাড়ি। রাজা কিংবা তার কোনো বংসধর বর্তমানে এই বাড়িতে না থাকলেও রাজার প্র্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এই পুরাতন রাজবাড়িটি আজও তার কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

১৯৪৭ সালে রাজা বীরবাবু ও তার পরিবারবর্গ ভারতের হুগলী জেলার চন্দননগরে চলে যাওয়ার পর থেকেই অদ্যাবধি এ বাড়িটিতে স্থায়ীভাবে কোনো লোকজন বসবাস করে না। ফলে রাজার অবর্তমানে এক কালের বিলাশবহুল এই রাজবাড়িটি এখন পথচারী ও দর্শনার্থীদের শুধু দৃষ্টি আকর্ষন করা ছাড়া আর কারো কোনো উপকারে আসছে না। তবে প্রায় সাত যুগ ধরে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সংষ্কারের অভাবে অযত্নে -অবহেলায় পড়ে থাকায় দর্শনার্থীদের দৃষ্টিনাড়া সেকালের প্রাচীন বিলাশবহুল এই রাজবাড়িটির সৌন্দর্য্য আজ ক্রমে ক্রমেই নষ্ট হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রায় আঠারো শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জমিদার অবিনাশ বাবু রাজশাহী জেলা সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিাটর উত্তর-পূর্বে এবং নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিাটর উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এ দুটি জেলার বাগমারা-আত্রাই উপজেলার সীমান্তবর্তী বীরকুৎসা গ্রামে ৫০ বিঘা জমির উপর এক তলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জমিদার অবিনাশ বাবুর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। এ কারণে তিনি ভারতের হুগলী জেলার চন্দন নগরে তার ভাগ্নে পঞ্চানন বাবুর সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেন। এরপর জামাই ও মেয়েকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং জামাই পঞ্চানন বাবুকে তার জমিদারীর দায়িত্বভার প্রদান করেন।

এরপর পঞ্চানন বাবু এই বাড়িতে থেকেই সংসার জীবন শুরু করেন। কিন্তু জমিদার অবিনাশ বাবুর মৃত্যুর পর তিনিই এই বাড়ির মালিক হন। সংসার জীবনে পঞ্চানন বাবু ৩ পুত্র সন্তানের জনক হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করেন। তার পুত্রদের নাম- রামাবাবু, দূর্গাবাবু ও বীরবাবু। তবে এই তিন পুত্রের মধ্যে পঞ্চানন বাবুর প্রিয় পুত্র ছিলেন বীরবাবু। তিনিই পরবর্তীকালে তার পিতার জমিদারীত্বের সূত্র ধরে রাজার দায়িত্ব পালন করেন। বীরকুৎসা গ্রামের শতবর্ষী রামাকান্ত ঠাকুর (১১০) বলেন, বীরবাবু রাজার দায়িত্ব পাওয়ার পর এক তলা বিশিষ্ট এ বাড়িটিকে সংষ্কার করেন এবং এক হাজার দরজা ও ৫ হাজার জানালা বিশিষ্ট দ্বীতল বাড়িতে রুপান্তর করেন। এ বাড়িটিতে এক হাজার দরজা থাকার কারণে নাকি এলাকাবাসীর কাছে বাড়িটি রাজা বীরবাবুর হাজার দুয়ারী রাজবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। তবে বর্তমানে বাড়িটির বিশেষ বিশেষ অংশ ভেঙ্গে পড়েছে এবং এর দরজা-জানালাসহ বাড়ির অতি মূল্যবান আসবাবপত্রগুলো সবই নষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া বর্তমানে বাড়িটি সরকারের নিয়ন্ত্রনে চলে আসলেও প্রায় সাত যুগ ধরে এ বাড়িটিতে স্থায়ীভাবে কোনো লোকজন বসবাস না করায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সংষ্কারের অভাবে অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকায় প্রাচীন বিলাশবহুল এই রাজবাড়িটির সৌন্দর্য্য আজ ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে এলাকাবাসীর কাছে হাজার দুয়ারী এই রাজবাড়িটিকে ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে নানা স্নৃতি।

এ প্রসঙ্গে বীরকুৎসা বাজারের আব্দুল মোতালেব নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি তার দাদা-দাদির কাছে থেকে গল্প শুনেছেন, রাজা বীরবাবুর নামানুসারে এই এলাকার নাকি নামকরণ হয়েছে বীরকুৎসা। অন্য মতে, বীরবাবু ছিলেন অত্যন্ত কালো কুৎসিত চেহারার একজন সাহশী ও শক্তিশালী যোদ্ধা। এ কারনেই নাকি এ এলাকার নামকরণ হয়েছে বীরকুৎসা। তাছাড়া তার নামানুসারে এই এলাকার বিল, রেল স্টেশন, স্কুল ও কলেজসহ সব কিছুরই নামকরণ হয় বীবকুৎসা। এই নামগুলো আজোও বীরবাবুর নামের পরিচিতি জানান দিয়ে আসছে এবং রাজা বীরবাবুর নানা স্নৃতি বহন করে সেগুলো আজোও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এ রাজবাড়ি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, রাজাবাড়ির পূর্ব দিকের আংশিক ভেঙ্গে পড়া দরজা-জানালা বিহীন একটি কক্ষের মেঝেতে গামছা বিছিয়ে শুয়ে আছেন কালীপদ শাহা (১১৫) নামের এক বৃদ্ধ। প্রচন্ড শীতে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, রাজা বীববাবু যখন এ এলাকায় রাজত্ব করেছিলেন তখন থেকেই তিনি রাজার একজন নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী হিসাবে এই বাড়িটি পাহারা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে রাজা বীরবাবু ও তাঁর পরিবারবর্গ ভারতের হুগলী জেলার চন্দননগরে চলে যান। এরপর এ বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। কালীপদ শাহা আরো জানান, রাজার শাসনামলে এ এলাকার প্রায় অর্ধশত লোক তাঁর কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু রাজার দেশ ত্যাগের পর ওই সব কর্মচারীরা সবাই একে একে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন এবং বর্তমানে তিনি ছাড়া সবাই পরলোক গমন করেছেন। কিন্তু এ বাড়িটির নানান স্নৃতি এবং অত্যন্ত সহজ-সরল ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ রাজা বীরবাবুর আদর-স্নেহ ও আদর্শের কথা এখনোও তিনি ভুলতে পারেন নি। এ কারণে অলিন্দ হৃদয়ের মণি কোঠায় লেগে থাকা স্নৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আজোও তিনি এ বাড়িটি বিনা বেতনে পাহারা দিয়ে আসছেন।

তবে বাগমারার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এই পুরাতন হাজার দুয়ারী রাজবাড়িটি বর্তমানে যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে তাই একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কাজেই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসী।

এফআর/অননিউজ

আরো দেখুনঃ