পদ্মাসেতু দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে ছুটবে ট্রেন, উচ্ছাসিত মানুষ
ভাঙ্গা, ফরিদপুর প্রতিনিধি।।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর পর এবার এই সেতু দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে ছুটবে ট্রেন। সড়কপথে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের উন্নয়ন যাত্রার সঙ্গে এবার যোগ হতে যাচ্ছে নতুন মাত্রা। ফলে রেলপথে সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবে ফরিদপুরসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরো বেশ কয়েকটি জেলা।
এদিকে, ট্রেন চালুর দিন-ক্ষণ যতোই এগিয়ে আসছে ততই যেনো এই জনপদের মানুষের কানে বাজছে ট্রেনের হুঁইসেল আর ঝক ঝকা ঝক শব্দ। এতে উচ্ছাসিত দক্ষিণ অঞ্চল তথা ফরিদপুর জেলার সর্বস্তরের মানুষ।
২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালুর এক বছর দুই মাস পর আসছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আগামী ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে ট্রেন চলাচল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দিন নতুন এ রেলপথের উদ্বোধন করবেন। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার রেলপথ চালু হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুনে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের প্রায় ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করে বাংলাদেশে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। পদ্মা সেতুর রেললিংক ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করবে প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিআরইসি)।
ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামীলীগের সা.সম্পাদক আকরামুজ্জামান রাজা বলেন রাজনীতি ও ব্যবসার কাজে প্রায়ই তাকে ভাঙ্গা হতে ঢাকা যেতে হয়। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী উন্নয়ন করেছেন তার একটি নবতম সংযোজন পদ্মাসেতুতে রেল লাইন সংযোগ। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ যেমনভাবে উন্নত হবে তেমনি বর্হিবিশ্বে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো প্রশংসিত হবে। এ অঞ্চলের মানুষ নিজেদের উৎপাদিত পণ্য সহজে ও কম খরচে রাজধানীতে পাঠাতে পারবে। ফলে সর্বক্ষেত্রে জীবনমান উন্নত হবে।
ভাঙ্গার স্থানীয় সাংবাদিক সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘যে কাজগুলোর কথা আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেগুলো করে দেখাচ্ছেন। পদ্মাসেতুর পর আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় উপহার রেল সংযোগ। চিন্তাই করা যায়না রেলে এক ঘণ্টায় ভাঙ্গা থেকে ঢাকায় পৌঁছে যাব। তবে আমি মনে করি ভাড়াটা একটু কম এবং পর্যাপ্ত ট্রেনের ব্যবস্থা করলে মানুষ বেশি উপকৃত হবে।’
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা কলেজের প্রফেসর শামসুজ্জামান মিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্ন পুরণ করেছে। জীবনযাত্রার মানসহ নানা দিক দিয়ে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ভোগান্তি শেষ হয়েছে। কয়েকদিন পরেই রেল চলবে এমন খবর ঢাকা যাওয়ার পথে ভাঙ্গায় যাত্রাবিরতি করে ঘুরে দেখলাম। অনেক আনন্দ লাগছে। গর্ব লাগছে।
নগরকান্দা পৌরসভার ছাগলদি গ্রামের বাসিন্দা জাহিদ ঢাকায় একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর সুফল দক্ষিণ অঞ্চল তথা ফরিদপুরের মানুষ পাচ্ছে। তবে সড়কপথে বাসে ঢাকায় যেতে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ভাড়া লাগে। সেখানে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় ঢাকায় নিরাপদে যাওয়া যাবে। এটি সব শ্রেণির যাত্রীর ক্ষেত্রেই বড় প্রভাব ফেলবে। সর্বস্তরের মানুষ নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ সুবিধার পাশাপাশি সকল ক্ষেত্রে লাভবান হবে।’
ভাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ি রাজিবুল হাসান বাবু বলেন, ‘এলাকায় ও ঢাকায় ব্যাবসা-বাণিজ্য রয়েছে। ভাঙ্গা-ঢাকায় সপ্তাহে দুই তিনবার যাতায়াত করতে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার ব্যাবহার করা হয়। পদ্মাতেু চালুর পর যাতায়াত ব্যাবস্থা খুবই সহজ হয়েছে। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের সবক্ষেত্রে জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে। ট্রেন চালুর পর প্রাইভেটকারে আর চড়তে হবে না। এ অঞ্চলের মানুষের একটি নয় কয়েকটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’
ভাঙ্গার গৃহবধু বিথি বলেন তার ককেজন আত্মীয় থাকেন ঢাকায়। এ ছাড়া চিকিৎসা এবং নানা কাজে প্রায়ই ঢাকা যেতে হয়। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ শুরু হবার খবরে তিনি জানান, এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। শেখ হাসিনাকে যেন যুগ যুগ ভগবান ক্ষমতায় রাখেন।
ফরিদপুর শহরের বাসিন্দা ও ঠিকাদার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘এখনই দিনে দুইবার ফরিদপুর-ঢাকা যাওয়া আসা যায়। ট্রেন চালুর পর সড়কপথে যাত্রায় আরো সহজতর হবে। ইতোমধ্যে রেল চালুর খবরে অত্র অঞ্চলের মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বইছে। যেন তর সইছে না।’
ভাঙ্গা বাজারের কাঁচামালের আড়তদার ও ব্যবসায়ী নয়ন বলেন, ‘ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের কাঁচাপণ্য পরিবহনে ভাঙ্গায় আসে। ভোক্তা পর্যায়ে সেই পণ্যই বিক্রি হয় দ্বিগুণ দামে। এর পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যাপক সফলতা মিলবে। এতে মানুষ খুশি ও আনন্দিত।’
ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিম উদ্দিন বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচল শুরুর পর সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বড় সুযোগ। এ অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা এখন অর্ধেক ব্যয়েই রাজধানীতে শিক্ষার জন্য যাতায়াত করতে পারবে। এতে ভোগান্তি কমার পাশাপাশি কমবে শিক্ষার খরচ। এ অঞ্চলের মানুষের সবক্ষেত্রেতো বটেই, ব্যবসা-বাণিজ্যে দ্বিগুণ গতি সঞ্চারিত হবে বলে আশা ব্যবসায়ী মহলের। জিনিসপত্রের দামেও পড়বে ইতিবাচক প্রভাব।’
ফরিদপুর রেলওয়ে স্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টার তাকবীর হোসেন বলেন, ‘এই রুটে ক’টি ট্রেন চলবে, যাত্রীপ্রতি ভাড়া কত হবে। এখনও আমাদের কাছে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি। তবে অনুমান অনুযায়ী, ঢাকা-ফরিদপুর জনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকার মতো ভাড়া হতে পারে। কারণ, ফরিদপুর থেকে রাজশাহী চলাচলকারী মধুমতী এক্সপ্রেসে আড়াইশ কিলোমিটারের ভাড়া ২৫০ টাকা। ঢাকা-ফরিদপুর রেল দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার।’
এফবিসিসিআইয়ের সহ সভাপতি ও ফরিদপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সিআইপি যশোদা জীবন দেবনাথ বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু একটি স্বপ্ন পুরণের পর ট্রেনচালু, আরেক স্বপ্ন পুরণ হয়েছে। ভাঙ্গার পর যশোর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হলে ট্রেনে এসব পণ্য অল্প খরচে আনতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া, মহাসড়কে যানজট ও বিভিন্ন দুর্ভোগ এড়িয়ে ট্রেনে কম ভাড়ায় এবং সঠিক সময়েই বিভিন্ন পণ্য আনা-নেওয়ার সুফল মিলবে।’
এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর পর এবার রেল নিয়ে নতুন পরিকল্পনার স্বপ্ন বুনছে। দক্ষিণের মানুষ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে রেলপথে ঘরে ফিরবে। রেল ভ্রমণ সব সময়ই নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। শুধু যাত্রী নন, পণ্য পরিবহনেও ব্যবসায়ীরা ঝুঁকবেন রেলপথে।’
তিনি বলেন, ‘ট্রেন চালুর পর সাধারণ যাত্রী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীসহ এই এলাকার সর্বস্তরের মানুষ নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ সুবিধার পাশাপাশি সকল ক্ষেত্রে লাভবান ও সুফল ভোগ করবে। বাঁচবে অর্থ, বাঁচবে সময়। বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিসর। ফলে দক্ষিণ অঞ্চল তথা ফরিদপুরের সর্বস্তরের মানুষ আনন্দিত-উচ্ছাসিত।’
যে ট্রেনে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আসবেন প্রধানমন্ত্রী, সেই ট্রেনের চলছে ট্রায়াল। আর মাত্র একদিন পর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে ট্রেন চলাচল। এদিন ট্রেনে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যে ট্রেনটিতে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিবেন সেই বিশেষ ট্রেনটি ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে। পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রথমবার ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা হয়ে ঢাকার দিকে যায় এ ট্রেন। আরো কয়েকবার চলবে এ ট্রায়াল।
ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. শাহজাহান জানান, আগামী ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-ভাঙ্গা রেল চলাচলের উদ্বোধন করবেন। এরপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ রেলপথ বাণিজ্যিকভাবে খুলে দেওয়া হবে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার রেলপথ চালু হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যে ট্রেনটিতে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিবেন সেই বিশেষ ট্রায়াল ট্রেনটি পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা হয়ে ঢাকার দিকে গিয়েছে।
সত্যতা নিশ্চিত করে রেলের পাকশী ডিভিশনের গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর অব বাংলাদেশ রেলওয়ে (জিআইবিআর) মো. রুহুল কাদের আজাদ বলেন, ‘শুক্রবার বিশেষ এ ট্রেনটি পাকশী থেকে ছেড়ে আসে। ট্রেনটি ১৩টি বগি বিশিষ্ট ও ২টি পাওয়ার ইঞ্জিন সম্বলিত। বিশেষ এ ট্রেনটিতে চড়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আসবেন। প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা বিশেষ এ ট্রেনটি পরীক্ষামূলক ভাবে ১০ অক্টোবরের আগে আরো বেশ কয়েকবার পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করবে, যা ট্রায়ালের একটি অংশ।’
এফআর/অননিউজ