পাইপলাইনে ডিজেল বাণিজ্য, লাভবান হবে বাংলাদেশ-ভারত
অনলাইন ডেস্ক।।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও উষ্ণ বাংলাদেশের জন্মলগ্ন সেই ১৯৭১ সাল থেকেই। যেকোনো সংকটকালীন সময়েই ভারত ও বাংলাদেশ নিকজেদের পাশে পেয়েছে একেবারে নিকট্মাতীয়ের মতোনই। সেটা হালের করোনা মহামারীই হোক, কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। তবে, বর্তমানে মহামারী পরবর্তী যুদ্ধকালীন বৈশ্বক সংকটে এখন টালমাটাল সারা বিশ্ব। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি জ্বালানি সংকটও হয়েছে তীব্রতর।
বাংলাদেশও পড়েছে এই সংকটের ভয়াল থাবায়। এই বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট নিরসনে বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি খরচ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই খরচ কমানোর জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি করাটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। যদিও, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া এবং ব্রুনাইয়ের মতো দেশগুলির সাথে জ্বালানি তেল আমদানির ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতই প্রথমে জ্বালানি সরবরাহে এগিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতার বহুমাত্রিক পথের সূচনা কিন্তু একমাত্র ভারতের সাথে ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণেই সম্ভব হয়েছে। তার অন্যতম প্রধান উদাহরন হলো পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আমদানি। এই আমদানি ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগলিক নৈকট্যের সর্বাধিক উপযোগিতা নিশ্চিত করবে।
এই বছরের জুনে ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আসবে। একবার ডিজেল যখন এই ডিজেল আসা শুরু করবে, বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে। এই ডিজেল বাণিজ্যে উভয় দেশ অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে এবং বাংলাদেশ তার জ্বালানি সংকট আরো দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করতে পারবে। ভারতও এতে কম লাভবান হবেনা বৈকি। এই ডিজেল রপ্তানির মাধ্যমে ভারত রাজস্ব আয় করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে ভারত ইতিমধ্যে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে।
শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ-ভারত বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
বাংলাদেশ-ভারত ডিজেল বাণিজ্য
২০১৭ সাল থেকে রেলওয়ের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ ডিজেল বাণিজ্য চলে আসছে । প্রতি মাসে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে প্রায় ২২০০ টন ডিজেল পাঠানো হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানির জন্য এই পরিবহন খরচ বেশ ব্যয়বহুল ছিলো। যখন এই পাইপলাইন চালু হবে, দেশে জ্বালানি সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে এবং রেলওয়েযোগে জ্বালানি পরিবহন খরচ কমবে।
আমন ও বোরো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ডিজেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায় সরকার পাইপলাইনের মাধ্যমে এই জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬টি জেলায় ডিজেল গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে কৃষকদের তা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। ভারতের এই রপ্তানী শুধুমাত্র ভারতের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে না বরং জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ডলার সংকটের সময়ও বন্ধুত্বের বন্ধনকে সমুন্নত করবে। আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইনটি নিরবচ্ছিন্ন, সস্তা এবং দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ নিরাপত্তা ছাড়াও রেলওয়েতে পরিবহনের কারণে ছোটখাটো চুরির মাধ্যমে যে সিস্টেম লস হয় সেটি কমাতে সাহায্য করবে বলেও কিন্তু আশা করা যায়।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন চুক্তি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন চুক্তি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য নভেম্বর ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। যার মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে কাজের গতি কিছুটা মন্থর হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত। এখন এই বাংলাদেশ- ভারত মৈত্রী পাইপলাইনটি নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
১৩১.৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন প্রকল্পটি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এবং পার্বতীপুর,
দিনাজপুরকে সংযুক্ত করেছে। পাইপলাইনের মোট দৈর্ঘ্যের মধ্যে ১২৬.৫০ কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং বাকি ৫.০৭ কিলোমিটার ভারতে। নির্মাণ ব্যয় ৫২০ কোটি টাকার মধ্যে ভারত সরকার ৩০৩ কোটি টাকা এবং বিপিসি বাকি ২১৭ কোটি টাকা দিচ্ছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করা যাবে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে আড়াই লাখ টন আমদানি করা হবে। ১৫ বছরের চুক্তি অনুযায়ী, আমদানির পরিমাণ বাড়বে বছরে ৪ থেকে ৫ মেট্রিক টন।
সংকটকালে আশার আলো?
সারা বিশ্বের সাথে বাংলাদেশও যখন জ্বালানি সংকটে টালমাটাল, তখন এই ডিজেল বাণিজ্য
একধরনের আশার আলো দেখাচ্ছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য ডিজেল আমদানির বিকল্প উৎস তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে ৬.৫ মিলিয়ন টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এই আমদানীকৃত জ্বালানির ভেতর বছরে ৪ মিলিয়ন টন ডিজেল আমদানি করা হয়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পরিবহন খরচ কমিয়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ আমদানি করা জ্বালানি এদেশে আসবে। অধিকন্তু, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে জ্বালানি তেল (মালবাহীসহ) আনার জন্য প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) গড় প্রিমিয়াম ১০ ডলার খরচ পরে।
ভারত থেকে যদি এই জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় তবে আট ডলার খরচ পরে। ব্যারেল প্রতি দুই ডলার হ্রাসে প্রতি ১,০০,০০০ টনে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। জ্বালানি সরবরাহে কম সময় নেওয়ার পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তাই ভারত থেকে আমদানি করলে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। এখন ডলারের পরিবর্তে রুপিতে আমদানি করা সম্ভব হলে আমাদের ডলার সংকট কিছুটা হলেও কমবে। পরবর্তীকালে ভারত বাংলাদেশকে দামে কিছুটা ছাড় দিলে বাংলাদেশ আরও লাভবান হতে পারে।
অন্যদিকে, রপ্তানিকারক ভারত তার রপ্তানি আয় থেকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ অর্জন করতে পারে এবং তা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। এমনকি ভারত যদি বাংলাদেশে সুলভ মূল্যে পরিশোধিত তেল রপ্তানি করে, তাহলে তা উভয় দেশের জন্যই সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক লাভ বয়ে আনবে। ভারতও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক জ্বালানি সহযোগিতার মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট জ্বালানির উচ্চ মূল্যের বৈশ্বিক সমস্যাটি মোকাবেলা করতে পারে। যখন ডিজেল আসা শুরু হবে, তখন সঠিক ব্যবস্থাপনায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি সহযোগিতার একটি অন্যতম উদাহরণ হতে পারে। শুধু তাই নয়, এটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতায় একটি নতুন মাত্রার সূচনা করবে।
লেখক : সামারা আশরাত, পিএইচডি ফেলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ বার্তাবাজার