দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বন সংরক্ষণ করা প্রয়োজন

স্টাফ রিপোর্টার।।

বুধবার বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ‘একটাই পৃথিবী: প্রকৃতির ঐকতানে টেকসই জীবন’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে আরণ্যক ফাউন্ডেশন। পরিবেশ অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে সেমিনারটির আয়োজন করা হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরণ্যক ফাউন্ডেশনের ফরেস্ট ল্যান্ডস্কেপ রেস্টোরেশন বিশেষজ্ঞ ড. মহা. আব্দুল কুদ্দুস।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও অবক্ষয়িত বন নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনায় বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম কয়েক দশক আগেও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তাদের প্রথাগত চাষাবাদ পদ্ধতি যা জুমচাষ হিসেবে পরিচিত, তার আবর্তনকাল ২০ বছর থেকে ৫ বছরে নেমে এসেছে। এতে জুমচাষ আর টেকসই চাষাবাদ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারছে না। অনেকে জুমচাষের জমিতে কলা, আম, আনারস, হলুদ, আদা, কাজুবাদাম, কফি ও অন্যান্য ফলের বাগান করছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ জুমচাষে আগ্রহী না হয়ে ফলের বাগানে বেশি আগ্রহী হতে দেখা যায়। জুমচাষের আবর্ত কাল কমে যাওয়াতে মাটির উর্বরা শক্তিও কমে যাচ্ছে। ফলে স্থানীয়রা জুমচাষের নতুন জমির সন্ধানে ছুটছে। তারা অশ্রেণিভুক্ত বনসহ বন বিভাগের রিজার্ভ ফরেস্টে বা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঢুকে পড়ছে।

সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে যে, রাইংখ্যং ছড়ি সংরক্ষিত বনের ফারুয়া নামক স্থানে প্রায় ৩০০০ পরিবার বসতি স্থাপন করেছে যেখানে জনসংখ্যা ১৪ হাজারেরও বেশি। সরকার সে স্থানকে ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ রিজার্ভ ফরেস্ট বা সংরক্ষিত বনের ভেতরে এখন শুধু বসতি নয়, ইউনিয়ন পরিষদও স্থাপন হয়েছে। এভাবে বনের জমি কৃষি জমিতে রূপান্তর হতে থাকলে বনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ বনের প্রতিবেশ সেবা সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হবে। এটি টেকসই কোন ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নয়। শুধু জুমচাষকে দায়ী করা যথার্থ নয়। জুমচাষের পাশাপাশি উন্নয়নের জন্য সড়ক ও অন্যান্য স্থাপনা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিভিন্ন ফল ও কফি উৎপাদনের উৎকৃষ্ট স্থান মনে করছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ফলের চারা বিতরণ করে তা লাগানোর জন্য উৎসাহিত করছে। স্থানীয়রা পাহাড়ের গাছপালা কেটে সেখানে দেশি বিদেশি ফলের গাছ লাগাচ্ছে। এক ধরনের লোভী ব্যবসায়ীরা ঝিরির পাথর উত্তোলন করে পানির প্রবাহ ও পানি ভূগর্ভে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। এক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর বাঁশ জন্মাত এবং কর্ণফুলী পেপার মিলস্ সে বাঁশ কিনে নিত। কিন্তু বর্তমানে কাগজ উৎপাদন বন্ধ হওয়াতে বাঁশ আর বিক্রি হয় না। ফলে বাঁশ ঝাড় কেটে সেখানে জুমচাষ করছে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি বনের প্রতিবেশ সেবা থেকে স্থানীয়রা বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পার্বত্য এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা খুব বেশি রকমের ব্যাহত হবে।

তাই প্রতিবেশ সেবা পুনরুদ্ধারে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ফরেস্ট ল্যান্ডস্কেপ রেস্টোরেশন বা স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততায় বন ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার। এলাকার সঠিক অবস্থা নিরূপণ করে যেখানে বন বা গাছপালা খুব বেশি রকমের অবক্ষয় হয়েছে সেখানে জনগণের জন্য উপকারী গাছপালা ও গুল্ম, লতাজাতীয় গাছ লাগিয়ে ভূমি ক্ষয় রোধ করে ভূমির উর্বরা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে ভূমির ব্যবহার চিহ্নিত করে ফসলের জমি, ফল গাছের জন্য জমি এবং বন ও বন্যপ্রাণীর জন্য জমি নির্ধারণ করে সেখানে প্রত্যেক সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নিতে হবে যা স্থানীয়দের জীবন-জীবিকায় সহায়ক হয়।
সেমিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বন সংরক্ষক ও সভাপতি ইনস্টিটিউশন অফ ফরেস্টার্স, বাংলাদেশ। আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক, ড. মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ; এফএও বাংলাদেশের এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ ইউনিটের টিম লিডার ড. ক্রিস্টেফার জনসন এবং বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সিনিয়র এনভায়রনমেন্টাল স্পেশালিস্ট ড. ইশতিয়াক সোবহান।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুল হামিদ, এবং প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী।

আরো দেখুনঃ